
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবেলায় জলবায়ু বাস্তুচ্যুতিকে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং বাজেটে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা, স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক, কারিগরি ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, কমিউনিটি-ভিত্তিক টেকসই পুনর্বাসন ও জীবিকাভিত্তিক অভিযোজন কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা, স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা, মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করাসহ ভবিষ্যৎ ঝুঁকি হ্রাসে টেকসই উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। কারণ, জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলায় সরকারের বিদ্যমান উদ্যোগসমূহ অপর্যাপ্ত, বিচ্ছিন্ন ও স্বল্পমেয়াদি। উদ্যোগের বড় অংশই দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও অস্থায়ী পুনর্বাসনে সীমাবদ্ধ; টেকসই জীবিকা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকে, ফলে পুনর্বাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং মানুষ বারবার স্থানচ্যুত হয়।
আজ, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, কোস্ট ফাউন্ডেশন-এর উদ্যোগে আয়োজিত তজুমদ্দিন উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে “অভ্যন্তরীণ জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি ও টেকসই পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এই সকল দাবিসমূহ তুলে ধরেন। কোস্ট ফাউন্ডেশন-এর প্রোগ্রাম অফিসার রাজিব ঘোষ-এর সঞ্চালনায় ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ ইব্রাহীম-এর সভাপতিত্বে উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল ইসলাম, এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোস্ট ফাউন্ডেশন প্রোগ্রাম অফিসার আতিকুর রহমান। এছাড়া অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে ছিলেন সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ নুরনবী, উপ সহকারী প্রকৌশলী নাজমুল কবির, উপজেলা বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা কমিটি সভাপতি ও তজুমদ্দিন প্রেস ক্লাবের যুগ্ম আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন লিটন, ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যানসহ নাগরিক সমাজ, এনজিও, সাংবাদিক, ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা, যারা অংশগ্রহণ করে মতামত ব্যক্ত করেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় কোস্ট ফাউন্ডেশন-এর আতিকুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা কাঠামো। কেবল জরুরি সহায়তা বা বিচ্ছিন্ন পুনর্বাসন কোনো সমাধান নয়। বাস্তচ্যুত জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে কাছাকাছি কাজ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তাদের কারিগরি দক্ষতা, অর্থায়ন ও সমন্বয় ক্ষমতা সীমিত। স্থানীয় ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে পারলে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল ইসলাম বলেন, ভোলা জেলা এবং তজুমদ্দিন উপজেলা অন্যান্য জেলার থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম, কারণ এখানে প্রমত্তা মেঘনার নিয়মিত ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলতেই থাকে। তাই এখানে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি অন্যান্য জেলার থেকে অনেক বেশি। অন্যান্য জেলার মানুষের মতো এখানকার মানুষ সঞ্চয় করতে পারে না, কারণ তারা নিয়মিতই ভাঙ্গা গড়ার সাথে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলায় সরকার আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, এবং আগামীতে যেসব আবাসনের সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো সংস্কার করা হবে। আগামীতে বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগে জোর দেয়া হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ ইব্রাহীম বলেন, তজুমদ্দিনে ৫১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনার নদীর সংস্পর্শে অবস্থিত। আমরা যা করবো তা সমন্বিতভাবে না করলে সুফল পাবো না। আগামীতে আবাসনগুলোতে যাতে আঙ্গিনাভিত্তিক ক্ষুদ্রচাষাবাদ করতে পারে, সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি লবন-সহিষ্ণু চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে কাজ করা হবে এবং বাঁধ রক্ষায় বনায়নের উদ্যোগও সমন্বিতভাবে নেওয়া হবে।
হেলাল উদ্দিন লিটন বলেন, তজুমদ্দিনে বেড়িবাঁধ বর্ধিতকরণের কাজ চলছে, ফলে প্রায় ৫০০ পরিবার নতুন করে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের অধিকাংশই স্থান্তরিত ও পেশা পরিবর্তনের ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া এখানে অসংখ্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হলেও যথাযথ স্থান নির্বাচন না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এবং চাহিদা যথাযথভাবে যাচাই না করে ঘর বন্টন করার কারণে প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি। তাই বাঁধ নির্মাণের পূর্বে বাস্তুচ্যুতদের সত্যিকারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে জনমত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাস্তুচ্যুতি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শামীম বলেন, ভৌগলিক কারণে নদী ভাঙনের তীব্র ঝুঁকিতে আমরা আছি। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি, তবে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাসেরও উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে এবং স্থানীয় যুব সমাজকে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
সঞ্চালক রাজিব ঘোষ বলেন, তজুমদ্দিন উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে বড় মলংচরা প্রায় সম্পূর্ণ নদীগর্ভে, সোনাপুর, চাঁদপুর ও চাঁচড়ার বৃহৎ অংশ নদীগর্ভে বিলীন। এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করে, তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটে বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাস্তুচ্যুতদের প্রতিনিধি নাছরিন বেগম বলেন, চাঁদপুর ইউনিয়নের চৌমুহণী আবাসনে আমাদের ১০টি পরিবার বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে ঘর ও জমিহারা হচ্ছি। আমাদের ভবিষ্যৎ কি? মিলন রারি বলেন, মাওলানাকান্দি আবাসনে আমরা প্রায় ১৫ বছর যাবত বসবাস করছি; বর্তমানে ঘরগুলো একেবারেই বসবাসের অযোগ্য। বর্ষায় পানি ঢুকে আবাসনটি পুনঃনির্মাণের দাবী জানাচ্ছি। ছাত্র রাহাত বলেন, তজুমদ্দিনের চরগুলোতে আবাসন আছে, কিন্তু মানুষ বসবাসের অযোগ্য এবং জনবিচ্ছিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে। নেই কোনো শিক্ষার সুযোগ, নেই স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা, রয়েছে নিরাপত্তার শঙ্কা। চরে বেড়িবাঁধ না থাকায় সামান্য নিম্নচাপেই লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করে, তাই প্রয়োজন সমন্বিত চর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ।