বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী এক নাম বেগম খালেদা জিয়া। ছিলেন সেনাপ্রধানের স্ত্রী, ফার্স্ট লেডি এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়া বেগম খালেদা জিয়া অর্জন করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতার সবগুলো আসন, একই সাথে দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে নির্যাতন-কারাবাস এবং অকুতোভয় নেতৃত্ব দিয়ে জাতির কাছে হয়ে উঠেছেন আপসহীন নেত্রী।
কিংবদন্তি হয়ে ওঠা মহীয়সী এই নেত্রী ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬০ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস দুই সন্তানসহ গৃহবন্দি অবস্থায় কাটে খালেদা জিয়ার জীবন। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি–জনতার সংহতি ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন। সে সময় খালেদা জিয়া ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ; দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। কে দলের হাল ধরবেন—তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দলের ভেতরে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। এর আগে ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। বিগত কিছুকাল ধরে আমি বিএনপির কার্যক্রম গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। দলের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হতে পারে মনে করে আমাকে দলের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তাই দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিতে যোগ দিয়েছি ও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং শহীদ জিয়ার গড়া দলে ঐক্য ও সংহতির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়াই আমার লক্ষ্য।’
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন। একই বছরের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির শীর্ষ পদে নির্বাচিত হন তিনি।
দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকেই স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন খালেদা জিয়া। কোনো সমঝোতার পথে না গিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনকে তীব্রতর করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ‘এরশাদ হটাও’ একদফা আন্দোলনের ডাক দেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রথমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব তিনি দুই দফা পালন করেন। নির্বাচনী রাজনীতিতে তার রয়েছে ব্যতিক্রমী সাফল্য—পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটিতেই বিজয়ী হন তিনি।
সেনাসমর্থিত ওয়ান–ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ কারাবাসের পর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি মামলাগুলোতে জামিন পেয়ে মুক্তি পান। ওই সময় তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি দেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তার অভিযোগ ছিল, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাকে ওই বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়, যেখানে তিনি ২৮ বছর বসবাস করেছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার ওই বাসভবনটি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা দায়ের হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি দণ্ডিত হন। পরবর্তীতে গত ৬ আগস্ট সরকারের নির্বাহী আদেশে তার সাজা মওকুফ করা হয়। একই সঙ্গে গত ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি খালাস পান।
রাজনীতিতে প্রবেশের শুরু থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ‘আপসহীন’ নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়া। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে ও ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওয়ান–ইলেভেনের সময়ও তাকে কারাবরণ করতে হয়। দেশ ছাড়ার চাপ থাকলেও তিনি কখনো বিদেশে পাড়ি জমাননি।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তিনি বারবার কারাবরণ ও রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়েন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, কারাগারে থাকা অবস্থায় তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার আবেদন জানানো হলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের আদেশে তিনি মুক্তি পান।