
মহান বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তার পরিবারের ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা প্রদান করছে।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, “জাতীয় নেত্রী, দেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ বিষয়টি আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে শুরু থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার, দেশের উন্নয়নে অবদান এবং জনগণের শ্রদ্ধাময় আবেগ বিবেচনা করে সরকার ইতিমধ্যে তাকে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পরিবারের ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। দেশের চিকিৎসার পাশাপাশি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাও সরকারের নজরে রয়েছে।”
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের প্রসঙ্গেও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “আমরা চাই এই নির্বাচন হোক সত্যিকার অর্থে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু। নিরাপত্তা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং পর্যবেক্ষণের প্রতিটি ধাপ আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
তিনি ভোটারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “নতুন বাংলাদেশ গঠনের দায়িত্ব আমাদের সবার। আপনার মূল্যবান ভোটই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাই ভোটকে শুধুই কাগজে সিল মারার আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখবেন না; এটি হবে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা এবং দেশের উন্নয়নে সরাসরি অবদান।”
প্রফেসর ইউনূস রাজনৈতিক নেতাদেরও সতর্ক করে বলেন, “আপনারা একে অপরকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখবেন, কখনো শত্রু হিসেবে দেখবেন না। নির্বাচনের মাঠে এমন একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে জনগণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আরও আত্মবিশ্বাসী হন।”
ভোটের গুরুত্বে তিনি বলেছিলেন, “যারা ভোট বাক্স ডাকাতি করবে, তারা দেশের মানুষের স্বাধীনতা হরণকারী। ভোট জনগণের ভবিষ্যৎ রচনার অক্ষর। আপনার ভোট সযত্নে ভোট বাক্সে দিন। কেউ বাধা দিলে সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিহত করুন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিন। ভোটের ওপর নির্ভর করছে আপনার, আমার এবং আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ। যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিন। জাতির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন। মনে রাখবেন, ভোট রক্ষা করা দেশ রক্ষা করার সমান দায়িত্ব।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের জন্য প্রশাসনকে আরও কার্যকর, নিরপেক্ষ ও নির্বাচনী পরিবেশ উপযোগী করতে সরকারের পক্ষ থেকে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে কিছু রদবদল করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এগুলো কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের ভিত্তিতে নয়; এটি দক্ষতা, যোগ্যতা ও পেশাগত সক্ষমতার ভিত্তিতে করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য একটাই; দেশের প্রতিটি ভোটার যেন নিরাপদ, ভয়মুক্ত ও স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন।”
জুলাই সনদ ও তার গণভোট প্রসঙ্গে প্রফেসর ইউনূস বলেন, “জুলাই সনদ জাতির ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে আমরা যে সংস্কারমালা প্রস্তাব করেছি— রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, দুর্নীতি হ্রাস, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন জনগণের সুস্পষ্ট মতামত। একটি জাতীয় রূপান্তর কখনো একক নেতৃত্ব বা প্রশাসনের মাধ্যমে টেকসই হয় না; জনগণকেই চূড়ান্ত সম্মতি দিতে হয়। এই কারণেই গণভোটের আয়োজন করা হয়েছে— যাতে দেশের ভবিষ্যৎ সংস্কার দিশা নির্ধারণে জনগণ সরাসরি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এই গণভোট হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক।”
এবারের নির্বাচনকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একই দিনে দুইটি ভোট; একটি সংসদ সদস্য নির্বাচন, অন্যটি গণভোট। এ জন্য অবশ্যই ভোট দিন। আপনারা জানান, জুলাই সনদের সংস্কার কাঠামোকে এগিয়ে নিতে চান কি না। আপনার ভোটই নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র কোন পথে অগ্রসর হবে, প্রশাসন কোন কাঠামোতে পুনর্গঠিত হবে এবং নতুন বাংলাদেশ কেমন রূপ পাবে।”
প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গেও তিনি মন্তব্য করেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা কী তৎপরতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন। ফ্যাসিবাদের মসনদ গুঁড়িয়ে দিতে তারা অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু আমাদের প্রবাসীরা কখনো ভোটাধিকার পাননি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে এবার প্রথমবারের মতো লাখ লাখ প্রবাসী পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে যাচ্ছেন। এই উদ্যোগে অনেক প্রবাসী অংশ নিতে না পারলেও, ভবিষ্যতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন।”
অবশেষে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের অগ্রগতি তুলে ধরেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় পদক্ষেপ হচ্ছে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। আনন্দের সঙ্গে জানাই; ইতোমধ্যে বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে পৃথক সচিবালয় গঠন করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। এখন থেকে আর রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবের মাধ্যমে বিচারিক স্বাধীনতা ব্যাহত হবে না।”