ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণ করা গোলাম মোস্তফার ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৯:৪৭ পিএম, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫

অনেক বছর ধরে জনশ্রুত বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিমের (বীর বিক্রম) স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পেছনে নানা কারণের মধ্যে এই অপহরণের ঘটনাও একটি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বলে মনে করেন অনেকে।
১৯৭৪ সালে গাজী গোলাম মোস্তফা মেজর শরিফুল হক ডালিম ও তার স্ত্রীকে ঢাকা লেডিজ ক্লাব থেকে অপহরণ করে। মেজর ডালিমের আত্মীয় তাহমিনার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছিল কর্নেল রেজার। সেখানে এই ঘটনা ঘটে।
তর্কের বিষয়ে অন্তত দুইটি সংস্করণ চালু আছে উইকিপিডিয়ায়। একটিতে বলা হয়, ‘মোস্তফার ভাই ডালিমের স্ত্রী নিম্মির প্রতি অশালীন মন্তব্য করায় বচসার সূত্রপাত হয়। এতে মোস্তফার দুই ছেলেও জড়িয়ে পড়েন।’ আর আরেকটি সংস্করণ শোনা যায় সরাসরি মেজর ডালিমের মুখে।
গত রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের লাইভ টকশোতে দীর্ঘ দিন আড়ালে থাকা ডালিম কথা বলেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। লাইভে ৫০ বছরের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিদেশে নির্বাসিত আলোচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। এই লাইভে ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের ঘটনা জানতে চান ইলিয়াস।
জবাবে ডালিম বলেন, ‘এটা একটা মজার ঘটনা। আমি আমার বইতে এটির কথা উল্লেখ করেছি। আমার এক খালাতো বোন, পারভিনা, যার বিয়ের আয়োজন আমি ও নিম্নি, কর্নেল অলিউল্লা করেছিলেন, যিনি আমাদের চেয়ে জুনিয়র ছিলেন। বিয়ে ও অনুষ্ঠান লেডিস ক্লাবে হবে। দুই পক্ষই আমাদের পরিচিত ছিল। সব আয়োজন আমাদের ওপর ছিল। এই আয়োজনের মধ্যে ২-৩ হাজার লোককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিয়ের আসর চলছিল, তখন আমার একমাত্র শালা বাপ্পি, যিনি ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। সে অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিল। আমি ও নিম্নি দুই পক্ষের হোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম।’
‘বাপ্পি ছেলেদের বসার জায়গায় বসেছিল, তখন কিছু ছেলে তার চুল টানতে থাকে। প্রথম বারে বাপ্পি কিছু বলেনি, কিন্তু পরের বার টানার পর সে পেছনে তাকিয়ে দেখে একজন ছেলে। তারপর সে বলেছিল, ‘তুমি চুল টানছো?’ তখন ওই ছেলে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমরা দেখছিলাম, তোমার চুল এত সুন্দর, এটি কি পরচুলা না আসল?’ বাপ্পি বলেছিল, ‘বেয়াদব ছেলে, তুমি আর এখানে বসবে না।’ এরপর ছেলেগুলো চলে যায়।’
‘তারপর সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। কিছুক্ষণ পর রেডক্রসের দুইটি মাইক্রোবাস ও একটি গাড়ি এসে থামে এবং সাদা পোশাকধারী লোকেরা নামতে থাকে। গাজী গোলাম মোস্তফা, যিনি তখন আওয়ামী লীগ নেতা এবং রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন, গাড়ি থেকে বেরিয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন, ‘‘মেজর ডালিম কোথায়? কোথায় মেজর ডালিম?’’ এরপর তার সাথে ৮-১০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি উপস্থিত ছিল।’
গাজী গোলাম মোস্তফা মেজর ডালিমকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান, তবে এর মধ্যে মেজর ডালিম তাকে বাধা দেন এবং বলেন, ‘আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জানি না। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ আমাদেরকে দেখছে, আপনি যা করছেন তা আপনার জন্য ভাল হবে না।’ এরপর গাজী গোলাম মোস্তফা কিছুটা ভয় পেয়ে যান।
মেজর ডালিম বলেন, ‘তখন ঢাকা শহরে গাজী গোলাম মোস্তফা ছিল মুজিবের সবচেয়ে বড় লাঠিয়াল সরদার। তাকে রেডক্রসের চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল, যাতে লুটপাট করা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা তাকে বলেছিলাম, আপনি আগে অনুমতি নিন, না হলে আপনি পার পাবেন না।”
এই ঘটনার পর মেজর ডালিমের ছোট ভাই স্বপন (বীর বিক্রম) ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে যান এবং তিনি জানান যে বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশ গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়িতে অভিযান চালায়।
এরপর গাজী গোলাম মোস্তফার ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ গাজী গোলাম মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন।
মোস্তফা ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বার্ষিক অনুদানের মাধ্যমে তিনি জনকণ্ঠ পত্রিকাকে সমর্থন করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোস্তফা রেডক্রস বাংলাদেশের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন। মোস্তফা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সিটি ইউনিটের সভাপতি ছিলেন।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তিনি বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে পাঠানো লাখ লাখ কম্বল ও শিশু খাদ্যের টিন আত্মসাৎ করেছিলেন। এই ত্রাণসামগ্রী, যা দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর একটি বড় অংশ ভারতে পাচার করা হয় এবং স্থানীয় জনগণের কাছেই বিক্রি করে দেন তিনি। অভিযোগ অনুযায়ী, সাতটি শিশু খাদ্যের টিনের মধ্যে মাত্র একটি এবং ১৩টি কম্বলের মধ্যে মাত্র একটি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছেছিল। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিবের জন্য পাঠানো কম্বলও আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
এছাড়াও তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রীকে অপহরণের মত ঘটনার সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উইকিপিডিয়া থেকে আরও জানা যায়, মোস্তফার দুই ছেলে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা আরও কয়েকজনসহ ডালিম, তার স্ত্রী নিম্মি, কর্নেল রেজার মা এবং ডালিমের আরও দুইজন বন্ধুকে উঠিয়ে একটি রেড ক্রিসেন্টের মাইক্রবাসে করে অপহরণ করেন।
গাজী মোস্তফা এবং তার ছেলেরা প্রথমে তাদেরকে রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তরে নিয়ে যান। পরে সবাইকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় নিয়ে যান।
তবে ইতোমধ্যে ডালিমকে অপহরণের খবরে বেঙ্গল ল্যান্সার্স মোস্তফার বাড়িটি আক্রমণ করে এবং সবাইকে জিম্মি করে। সারা শহরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হয়। প্রতিটা গাড়িতে ডালিমদেরকে খোঁজে উদ্ধারের জন্য। শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধানকে ডাকিয়ে, তার সামনে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা মধ্যস্থতা করেন এবং মোস্তফাকে নিম্মির কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ৭৫’-এর আগস্টে শেখ মুজিবের প্রশাসনের পতনের পর মোস্তফা বিপুল অর্থসহ স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করার সময় পথচারীদের হাতে ধরা পড়ে। তখন তাকে জেলে পাঠানো হয়।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মোস্তফা কারাগারে বন্দী ছিলেন। সামরিক আইন আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন এবং ১৯৮০ সালের ২৮ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পরে গাজী গোলাম মোস্তফা আজমিরে মুইন আল-দীন চিশতির মাজার পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তার পরিবার নিয়ে ভারত গিয়েছিলেন এবং কিছু দিন দিল্লিতে ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি গাড়িতে করে আজমীর যাওয়ার পথে একটি ট্রাকের সঙ্গে তাদের গাড়ির সংঘর্ষ হলে মোস্তফা এবং তার পুরো পরিবার মারা যায়।