৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা স্থলবন্দরে
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৭:৩৫ পিএম, ২৮ জুন ২০২৫

বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞার পর দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে স্থলবন্দর ব্যবহার করে পোশাকের পর এবার পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির সুযোগ বন্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশই বেশি ক্ষতির শিকার হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন। খবর বিবিসির।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন বলেন, ভারতের নতুন সিদ্ধান্তের প্রভাব দেশের পাটশিল্পে কতটা পড়বে সেটি তারা বিশ্লেষণ করছেন।
তিনি আরও বলেন, কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ হবে হয়ত। তবে স্থলবন্দর না হলে নৌপথে কীভাবে রপ্তানি চালু রাখা যায় সে আলোচনা এর মধ্যেই শুরু হয়েছে।
ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাবেক সদস্য ও বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান বলছেন, স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বন্ধ হলে সেটি নৌপথে রপ্তারি করে পোষানো খুবই কঠিন বিষয় হবে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণেই এসব পালটিপালটি পদক্ষেপ হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাকের পর পাট রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আমার মনে হয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত আমাদের স্বার্থেই।
যদিও ভারতের সবশেষ পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে এখনো কোনো বক্তব্য আসেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।
প্রসঙ্গত, গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে বাকযুদ্ধের পর ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে।
ফলে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন সরাসরি ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে, যা দ্রুত সমাধান করা দরকার বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
ভারতের ঘোষণায় কী বলা হয়েছে
শুক্রবার ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে নয় ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কথা প্রকাশ করা হয়।
যদিও ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব পণ্য মুম্বাইয়ের নহ্ভা সেভা বন্দর দিয়ে ভারতে যেতে পারবে।
স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করা এসব বাংলাদেশি পণ্যে মূলত পাট ও পাটজাত পণ্য বেশি। এর মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা, একাধিক ভাঁজের বোনা কাপড়, একক শণ সুতা, পাটের একক সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে এ তালিকায়।
ভারত এ ধরনের যে নয়টি পণ্যের ওপর স্থলবন্দর নিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, এসব পণ্য থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় পনের কোটি ডলারের কাছাকাছি, যার প্রায় সবটাই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়েছিল।
রাজস্ব বোর্ডের হিসেবে, এই পনের কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে মাত্র বিশ লাখ ডলারের রপ্তানি স্থলবন্দর দিয়ে হয়নি।
তবে ভারতীয় বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে ওই নয় ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ভারতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে, যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ নয়শ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। মূলত ভারতীয় ভোগ্যপণ্যের বড় বাজার হলো বাংলাদেশ।
ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো পোশাক এবং এরপর পাট ও পাটজাত পণ্যই দেশটিতে বেশি যায় বাংলাদেশ থেকে।
এছাড়া প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতেও বাংলাদেশ ভালো করছিল। এর ওপরে আগেই বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে
শুক্রবার স্থলবন্দর দিয়ে নয়টি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ দিল ভারত।
এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল।
তারও আগে গত ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।
এর আগে আটই এপ্রিল অন্য দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছিল ভারত।
এরপর ১৫ এপ্রিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সূতা আমদানি বন্ধ করে ঘোষণা করে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ভারত অনেক দিন ধরে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু এখনকার পালটিপালটি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সংকট তৈরি করছে। এটা কারও জন্যই ভালো নয়। বাংলাদেশ ভারতের ওপর অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই নির্ভরশীল। আবার ভারতীয় পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের উপরেও নির্ভরশীলতা আছে। তাই দুই পক্ষই যত দ্রুত সমাধানে পৌঁছাতে ততই দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতি উপকৃত হবে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, তৈরি পোশাকের পরে ভারতে পাট ও পাটজাত পণ্যই বেশি যাচ্ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যদিও ২০১৭ সালে দেশটি বাংলাদেশি পাটপণ্যে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক আরোপ করে, যা ২০২৩ সালে আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়।
শেখ শামসুল আবেদিন বলছেন, ওই শুল্ক আরোপের কারণেও বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্য ভারতের রপ্তানিতে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের পাট ভালো করছিল।
তিনি বলেন, এখন হয়তো কাঁচাপাট রপ্তানি সংকটে পড়বে। তবে একই সঙ্গে দেশে পাটের ফিনিশড গুড উৎপাদন আরও বাড়ানো সুযোগ আছে। যদিও নৌপথে ভারতের রপ্তানির সুযোগ এখনো আছে। সেটি কতটা কাজে লাগানো যায় তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।