শুটকির রাজ্যে ভোরে ভ্রমণ: নাজিরারটেকের গন্ধ, গল্প আর জেলেদের জীবন
- ফরিদ শ্রাবণ
- প্রকাশঃ ০৮:৩৩ পিএম, ৩০ জুন ২০২৫

সারারাত নির্ঘুম কাটাতে চাইলাম। মনের অজান্তে কিভাবে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা। ভোর রাতে যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন তখনি কলিংবেল বেজে উঠল। চোখ মুছতে মুছতে দু কদম হেটে জানালার পাশে গেলাম, চোখ খুলে দেখলাম চারদিক অন্ধকার। হঠাৎ মনে পড়ল রাতে যে পরিকল্পনা করছিলাম তার কথা।
সময় ভোর ৬ টা। যেতে হবে শুটকির রাজ্য নাজিরারটেক মাছ ঘাট। ঘুম ঘুম চোখ মুচতে মুচতে আমর সঙ্গি হলো এক ছোট ভাই, তাকে সাথে নিয়েই হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। কক্সবাজারের মত এমন একটি পর্যটক এলাকা সকালবেলা জনমানবহীন লাগছে। বুঝার আর বাকি রইলনা সবাই এখন ঘুমের দেশে রয়েছে।
দশ কদম হাটার পরই পেলাম একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা। দুইশ টাকা রিজার্ভ ভাড়া করে এখন স্বপ্নের শুটকির রাজ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বলছি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শুটকি উৎপাদন কেন্দ্র নাজিরটেক মাছ ঘাটের কথা । বলা চলে বাংলাদেশের শুটকি উৎপাদনের ৭০ ভাগ শুটকি এখানে উৎপাদিত হয়। শো শো শব্দ করে গাড়ি সামনে এগোতে লাগলো, অন্যদিকে গাড়ির শব্দের সাথে বাতাসের শব্দ এক হয়ে অন্য রকম এক অনুভূতি শুরু হলো। বাতাসের গতিবেগ দেখে আর বুঝার বাকি রইলনা আমি যে সমুদ্রের পাড় দিয়েই ভ্রমন করছি। আঁকাবাকাঁ পথ আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। পথে পথে দেখা হলো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মক্তবে পড়তে যাওয়া। তা দেখে ক্ষনিকের জন্য হলেও আমার ছেলে বেলায় হারিয়ে গেলাম। তাতে বেশ কয়েকজনের সাথে খুনসুটি ও সালাম বিনিময় হলো।
হঠাৎ করেই বাতাসের গন্ধ পাল্টে গেল। বুঝতে পাড়লাম সামনে কিছু একটা অপেক্ষা করছে,ভাবতে লাগলাম শুটকির রাজ্যে আসলাম আর শুটকির গন্ধ পাবোনা কেমনে হয়। বুঝার আর বাকি রইলনা আমরা এতক্ষনে শুটকির রাজ্যে ডুকে পড়লাম। রাস্তার দু পাশে সারি সারি শুটকি শুকাতে দিচ্ছে নারী ও শিশুরা। শত শত একর যায়গা জুড়ে রয়েছে শুটকি। কেউ কাচা মাছ শুটকি করতে রোদে দিচ্ছে, কেউ বা আবার শুকনো মাছ মোড়ক করছে। পাশে বসে থাকা ছোট ভাই ও গাড়ির ড্রাইভার মুখে রুমাল বেধে নিলেন। বুঝতে পারলাম বাতাসে শুটকির দুর্গন্ধের মাএা বেড়েই চলছে। আমি গন্ধটি উপভোগ করছি, কারন শুটকির রাজ্যে আসলাম আর শুটকির গন্ধ নিবোনা তা কেমনে হয়। তাই মুখে রুমাল না বেধেই পথ চলতে লাগলাম। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম নাজিরটেক। গাড়ি থেকে নেমে চলে আসলাম নদীর ঘাটে ।
চারিপাশে অন্যরকম এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। নৌকা ঘাটে নোঙ্গর দিচ্ছে কোনটি আবার মাছ বিক্রি করে বসে আছে। মাছ ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে, ব্যস্ততা থেকে বাদ যায়নি গাঙ্গ চিলও। তারাও জেলেদের মাছ থেকে ভাগ বসাচ্ছে আর মনের আনন্দে সাতার কাটছে। আমাদের দেখে বেশ কয়েকজন জেলে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো।
পরিচিতি হতে লাগলাম তাদের সাথে। এরই মাধ্যে একজন জেলে আমার হাতে একটি জীবিত অক্টোপাস ধরিয়ে দিতে চাইল, আমিও ভয়ে ভয়ে এটিকে ধরতে পেরে নিজে নিজে হিরো বনে গেলাম। জেলেরা আমাদেরকে পেয়ে মহাখুশি হলেন । জানতে পারলাম বহু অজানা কথা । আরও জানতে পরলাম এক একটি জাহাজ ১০-১৫ দিনের জন্য চলে যায় ১০০-১২০ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে । মাছ ধরে ট্রলার বোজাই করে নিয়ে আসে। আবার কখনও আসানুরূপ মাছ ধরতে না পারলেও তারা থেমে থাকেননা। মৎস্য সম্পদের সাথে জড়িয়ে আছে এদের জীবন ।
জেলেপল্লীর নাম হলো ”কুতুবদিয়া পাড়া” মাছ যে ঘাটে বিক্রি তার নাম ”সমিতি পাড়া” মৎস্য কর্মীদের একেকজনের কাজ একেকরকম ভিন্ন ভিন্ন। কেউ মাছে ধরে আনে, কেউ স্থানীয় ভাষার পুটলি নামক ঝুড়িতে ভরে পাড়ে নামায়। পাইকাররা মাছ কিনে কিছু বাজারে কাঁচা বিক্রি করে এবং এর সিংহ ভাগই শুটকি করা হয়। বংশ পরাম্পরায় এখানে ছেলে বুড়ো সবাই মৎস্যজীবী। ছোট একটা বাচ্চা ছেলেকে কিছু মাছের নাম জিজ্ঞাস করলাম সে স্থানীয় ভাষাই ২০-৩০ টি মাছের নাম বলল।
আড্ডার সময় যে বেশ ফুরিয়ে এলো, এবার ফিরতে হবে। জেলেদের মন যতটুকু খারাপ তার চেয়ে আমার মন বেশি খারাপ। কারন এরই মধ্যে যে তাদের খুব আপন করে নিয়েছি । তাইতো বিদায়ের বেলায় একখানা গ্রুফ ছবি নিয়ে নিলাম । একজেলে ভাই আমার মোবাইল নাম্বারটি নিয়ে নিলেন। অন্য একজন জেলে কিছু শুটকি মাছ ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। টাকা পরিশোধ করতে চাইলে টাকা না নিয়ে ্একটি শর্ত বেধে দেন, শর্ত হলো পরবর্তীতে আমি আবার গেলে যেন তাদের সাথে দেখা করি।
হোটেলে ডুকে সবার মুভমেন্ট দেখে বুঝতে পারলাম তারা আমাদের না দেখতে পেরে চিন্তিত হয়ে খোজা খুঁজি শুরু করেছেন। অবশেষে যখনি আমরা শুটকি উৎপাদন খ্যাত নাজিরটেক এর কথা শেয়ার করি তখন তারা না যেতে পেরে বেশ মন খারাপ করলো। এমন সুন্দর যায়গায় পরবর্তী তাদের নিয়ে যাব বল ওয়াদা বদ্ধ হলাম।