স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুরের বিরুদ্ধে নতুন বিতর্ক: ২৬০৭ কোটি টাকার ব্যাংক কেলেঙ্কারি


স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুরের বিরুদ্ধে নতুন বিতর্ক: ২৬০৭ কোটি টাকার ব্যাংক কেলেঙ্কারি

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আবারও আলোচনায় এসেছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমানের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকে কর্মরত থাকাকালে এস আলম গ্রুপের অনুকূলে ২৬০৭ কোটি টাকার অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ–৭ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১–২২ অর্থবছরে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত প্রায় ৩০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২৩ কোটি থেকে ১৪৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করা হয়। এসব ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬০৭ কোটি টাকা। বর্তমানে এসব ঋণ সম্পূর্ণ খেলাপি, এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, তৎকালীন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (AMD) ও বিনিয়োগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাবিবুর রহমান এসব ঋণ অনুমোদনে “সরাসরি ভূমিকা” রাখেন। ঋণ প্রস্তাবের অফিস নোটে তার স্বাক্ষর পাওয়া গেছে, যা “প্রধান কার্যালয়ের প্রথম ও শেষ অনুমোদন” হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।

হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক মামলা রয়েছে। ২০০০ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্রেডিট বিভাগে দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ‘প্যাট্রিক ফ্যাশনস’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ গোপন করে নতুন করে ৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনের জন্য মিথ্যা তথ্য দেন—এমন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা হয় (মামলা নং ২৭২/২২)।

২০২৪ সালে এ মামলায় চার্জশীট দাখিলের পর হাইকোর্ট (রিট নং ৫২১৭/২০২৪) বাংলাদেশ ব্যাংককে ৬০ দিনের মধ্যে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। এর পরপরই তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদনও দেয়।

কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই আবারও তাকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে অনুমোদন দেয়।

এই সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ একই মামলায় চার্জশীটভুক্ত অন্য আসামি রবিউল ইসলামকে এনআরবিসি ব্যাংকের এমডি পদে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র জানায়, পুনঃনিয়োগের পর থেকেই হাবিবুর রহমান ব্যাংকে “অস্বাভাবিক ক্ষমতার প্রভাব” বিস্তার করেছেন। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেআইনি ও অযৌক্তিকভাবে চাকরিচ্যুত করেন।

একই সঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংকের সময়কার কয়েকজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে পুনঃনিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছেন ব্যাংকের বর্তমান মানবসম্পদ প্রধান মনসুর আহমেদ ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (CFO) মো. সালাহ উদ্দিন—যাদের নামও ইউনিয়ন ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।

দুদক সম্প্রতি এই তিনজনকেই (হাবিব, মনসুর ও সালাহ উদ্দিন) ইউনিয়ন ব্যাংকের অর্থ পাচার তদন্তে তলব করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের BRPD সার্কুলার নং ৩ ও ৪১ অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের সিএফও পদে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বর্তমান সিএফও সালাহ উদ্দিন এই যোগ্যতা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন।

একইভাবে, প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামানও সুপ্রিম কোর্টে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ও বার কাউন্সিলের সদস্যপদ ছাড়াই পদে নিয়োগ পেয়েছেন—যা নিয়োগনীতির সরাসরি লঙ্ঘন।

২০২৪ সালের BRPD সার্কুলার নং ৫ (ধারা ২(ক)(৮)) অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিরূপ মন্তব্য থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের এমডি বা সিইও হতে পারবেন না।
ফলে ইউনিয়ন ব্যাংক সংক্রান্ত পরিদর্শনে গুরুতর অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায়, হাবিবুর রহমান আইনগত ও নৈতিকভাবে এমডি পদে থাকার যোগ্য নন, এমন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের প্রতিক্রিয়া

অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, “একজন চার্জশীটভুক্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আবারও এমডি করা নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য। এটি ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট তৈরি করবে।”

একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “হাইকোর্টের আদেশে তাকে অপসারণের নির্দেশ ছিল। পুনঃনিয়োগ কীভাবে অনুমোদন পেল, তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে।”

ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১–এর ধারা ৪৫ ও ৪৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে কোনো ব্যাংকের এমডিকে অবিলম্বে অপসারণের ক্ষমতা রাখে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৬০৭ কোটি টাকার অনিয়ম, দুদকের মামলা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব বিধি—এই তিনটির আলোকে হাবিবুর রহমানের বর্তমান পদে থাকা আইনগত ও নৈতিকভাবে টেকসই নয়।

ইতিমধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাত অনাদায়ী ঋণ, করপোরেট প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় গভীর সংকটে রয়েছে। এ অবস্থায় চার্জশীটভুক্ত ও অনিয়মে অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তার বড় বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ পদে বহাল থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ও আর্থিক খাতের শুদ্ধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে “রাজনৈতিক নয়, নীতিনিষ্ঠ ও জবাবদিহিমূলক সিদ্ধান্ত নিতে,” নচেৎ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকও ইউনিয়ন ব্যাংকের মতো অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে পারে।

ঢাকাওয়াচের কাছে ১৩৯ পৃষ্ঠার নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও হাবিবুর রহমান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে হাবিবুর রহমানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে প্রতিবেদককে তুচ্ছতাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ দেখান। তিনি বলেন, "আমার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেন এমডি করা হয়েছে, তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রশ্ন করুন।"

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×