গভর্নরের নেতৃত্বে লন্ডনে টাস্কফোর্স: পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতে জোরাল কূটনীতি


April 2025/Ahsan Governer.jpg
আহসান এইচ মনসুর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গত ১৭-২১ মার্চ পর্যন্ত লন্ডন সফর করেন। এ সফরে তার ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল চুরি হওয়া বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আন্তঃসংযোগ (ইন্টারঅপারেবিলিটি) বিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ।  

এই সফরের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার- বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার লক্ষ্য নতুন গতি পায়।

চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধারে উদ্যোগ:

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ব্যাংকিং খাত এবং সরকারি দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, যা উদ্ধার করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বর্তমান সরকার।  এর প্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একটি ‘সম্পদ পুনরুদ্ধার পর্যালোচনা বৈঠক’ করেন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেন।  

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, যিনি সম্পদ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্সের প্রধানও, এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন।  

১৭ মার্চের কর্মসূচি:

যুক্তরাজ্যের সংসদ ভবনে দুর্নীতিবিরোধী অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপে (এপিপিজি) বৈঠক:  

যুক্তরাজ্যের সংসদ ভবনের পোর্টকুলিস হাউসে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে গভর্নর প্রধান অতিথি ছিলেন। এতে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য জো পাওয়েল, রূপা হক, ব্যারোনেস উদ্দিন এবং সাবেক লর্ড চ্যান্সেলর ও বিচারমন্ত্রী অ্যালেক্স চক। এছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, স্পটলাইট অন করাপশনসহ বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন, গণমাধ্যম এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা অংশ নেন।  

গভর্নর যুক্তরাজ্য সরকারের কারিগরি সহায়তা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্রের (আইএসি সিসি) সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধার শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংস্থা বাংলাদেশকে আরও বেশি সহায়তা দিতে আহ্বান জানায় এবং প্রয়োজনে পাচারকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরামর্শ দেয়।’

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরে এশিয়া বিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্টের সঙ্গে বৈঠক:  

গভর্নর বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার, সমস্যা জর্জরিত ব্যাংকের সম্পদ গুণগত পর্যালোচনা (এএকিউআর) এবং আইসিএআরের আইনগত সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।

১৯ মার্চ: সম্পদ পুনরুদ্ধার সেমিনার:

লন্ডনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে প্রায় ৩০টি আইন ও তদন্ত প্রতিষ্ঠান এবং ১০০ জনের বেশি অংশগ্রহণ করেন। গভর্নর বলেন, এই উদ্ধারপ্রক্রিয়া ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এবং জটিল। এতে বেসরকারি আইনজীবী, তদন্তকারী এবং আর্থিক সহায়তাকারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বব্যাংকের স্টার ইনিশিয়েটিভ এবং আইসিএআরের সহায়তায় এপ্রিলের মধ্যে একটি শর্তাবলি (টার্মস অব রেফারেন্স) প্রকাশ করা হবে।

সাবেক চ্যান্সেলর অ্যালেক্স চক বলেন, ‘লন্ডন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আইনগত কেন্দ্র হওয়ায় ‘লিগ্যাল লন্ডন’-এর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করতে পারে।’

গণমাধ্যম ও কৌশলগত যোগাযোগ:

গভর্নর আল জাজিরা, ফিনান্সিয়াল টাইমস, গার্ডিয়ান ও ডেইলি মেইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ উদ্ধার প্রচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের দুটি কৌশলগত যোগাযোগ সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করেন, কীভাবে আন্তর্জাতিক মহলে এই উদ্যোগকে আরও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা যায়।

বড় তিনটি আন্তর্জাতিক লিটিগেশন ফান্ডারের সঙ্গে আলোচনা:

এই সংস্থাগুলো জানায়, যথাযথ প্রমাণ পেলে তারা প্রাথমিকভাবে ৫ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। তারা শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আন্তঃসংযোগের অগ্রগতি:

গেটস ফাউন্ডেশন কর্মশালা (১৮-২১ মার্চ):

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরসহ ১২ জন কর্মকর্তার অংশগ্রহণে চারদিনব্যাপী কর্মশালায় কয়েটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এগুলো হল তাৎক্ষণিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির মৌলিক বিষয়; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থায় ভূমিকা; মোজালুপ নামক আন্তঃসংযোগ প্রযুক্তি পদ্ধতির সম্ভাব্য প্রয়োগ।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প আর্থিক কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা:

কর্মশালায় ছায়া ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে এজেন্ট ব্যাংকিং বিস্তারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় একটি নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বিকল্প ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি কেন্দ্র’ গঠনের ভাবনা উঠে, যা প্রযুক্তি, নীতি ও নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কারে কাজ করবে।

জিএসএমএর সঙ্গে কর্মশালা:

৭৫০টির বেশি মোবাইল অপারেটরের প্রতিনিধিত্বকারী জিএসএমএ-এর সঙ্গে আলোচনা হয় কীভাবে ‘নগদবিহীন অর্থনীতি’ গড়ে তোলা যায়।  কিউআর কোড, ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের প্রসার ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠক:

অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র আইজিসি’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক জনাথন লিপ এবং গবেষণা পরিচালক ড. টিম ডোবারম্যানের সঙ্গে আলোচনা হয়। তারা বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, পরিসংখ্যান বিভাগ পুনর্গঠন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জলবায়ু ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোতে যৌথ গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

এই সফর শুধু আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করেই থেমে থাকেনি, বরং বাংলাদেশের জন্য আর্থিক ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির পথও সুগম করেছে। চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, আর ভবিষ্যতের আর্থিক ব্যবস্থায় এটি বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×