.png)
চব্বিশের জুলাই আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগ কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছিল, যেখানে অরাজনৈতিক ব্যানারে শুরু হওয়া আন্দোলন ঠেকাতে দলীয় শক্তি মাঠে নামানো হয়। এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে ছিলেন তখন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আদালতের বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেনের একটি কল রেকর্ড শোনানো হয়। এই কথোপকথনের মধ্যে সাদ্দাম হোসেনকে বলতে শোনা যায়, 'আমি রাজাকার' বলার হিম্মত দেখায়, তাদের শেষ দেখে ছাড়বে ছাত্রলীগ।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই ফোনালাপ উপস্থাপন করা হয়। ১৬ জুলাই ছাত্রলীগ-পুলিশের হামলায় সারাদেশে ছয়জন শহীদ হন। ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি বানচালে শেখ হাসিনার সঙ্গেও ফোনে আলোচনা করেন কাদের। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮ জুলাই অনেকে প্রাণ হারান।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের সাত নেতার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। অভিযোগ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অন্য দুই সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
এই মামলার অন্য ছয় আসামি হলেন—আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ওয়ালি আসিফ ইনান।
আজ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাত আসামির আলাদা আলাদা অভিযোগ পড়ে শোনান। এর মধ্যে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে—নির্দেশ, প্ররোচনা ও উসকানি।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১১ জুলাই ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন কাদের। তিনি বলেন, “মারো না কেন ওদের, প্রশ্রয় দাও কেন।” ফোনালাপের এই কথায় উজ্জীবিত হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে, ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করা শেখ হাসিনার বক্তব্যে সমর্থন জানান কাদের ও মোহাম্মদ আরাফাতসহ শীর্ষ নেতারা। ১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের জবাব দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলন রুখতে উসকানি দেন কাদের।
১৬ জুলাই ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনানকে অর্থ সহায়তা দেন কাদের। একই দিনে ইন্টারনেট সেবার গতি কমাতে পলককে নির্দেশ দেন এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়রকে ফোনে হত্যাযজ্ঞে প্ররোচনা দেন। এর ফলে রংপুরে আবু সাঈদ ও চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ ছয়জন শহীদ হন, আহত হন আরও অনেকে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৭ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে কাদের সারাদেশের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ১৮ ও ১৯ জুলাই আন্দোলন দমনে সরকার ঘোষিত কারফিউ ভেঙে ও পুলিশের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
তৃতীয় অভিযোগে ৩ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কাদেরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। ৩ আগস্ট বৈঠক ডেকে বাহাউদ্দিন নাসিমসহ শীর্ষ নেতাদের পাড়া-মহল্লায় প্রস্তুত থেকে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন তিনি। অভিযোগে বলা হয়, জুলাই-অগাস্টে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হয়।
অন্য আসামিদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়। বাহাউদ্দিন নাসিম কাদেরের পাশে থেকে আন্দোলন দমনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। ৪ আগস্ট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এক সমাবেশে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের সঙ্গে তুলনা করে প্ররোচনা দেন। এতে উজ্জীবিত হয়ে ১৩ জন নিহত হন।
প্রসিকিউশন মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে ‘আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতা’ আখ্যায়িত করেন। ১৫ জুলাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বহিরাগত নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ঘটনায় ৩০০ জন আহত হন। ১৯ জুলাই এক বক্তব্যে তিনি বলেন, “পাঁচ বছর গুলি করলেও পুলিশের মজুত শেষ হবে না।” এছাড়াও, ২০ জুলাই কাদেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন। ফলস্বরূপ চারটি টেলিভিশনের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।
পরশও কাদেরের সঙ্গে সব বৈঠকে উপস্থিত থেকে উসকানি ও ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। ১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় ফোনে গোপন নকশা তৈরি করেন কাদের ও পরশ। ১৪-১৮ জুলাই নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালানো হয়, ১৯ জুলাই অস্ত্র হাতে মিরপুরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ৩ ও ৪ আগস্ট ধানমন্ডি এলাকায় বৈঠকে নেতাকর্মীদের উসকে দেন তিনি। এর ফলে মিরপুরে ৬৯ জন শহীদ হন, আহত হন আরও অনেকে।
শেষে প্রসিকিউটর তামিম সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আইন পড়ে শোনান। ট্রাইব্যুনাল সকলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং শুনানির জন্য ২৯ ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারণ করা হয়।