
ভারতের কলকাতার উপকণ্ঠে এক বাণিজ্যিক ভবনের অষ্টম তলায় বসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন দফতর। বাইরে থেকে দেখে কেউ আন্দাজও করতে পারবেন না, এই ঘর থেকেই কার্যত পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দলটির কর্মকাণ্ড।
এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের নেতারা এখন কলকাতার এই অঞ্চলে ভাড়া বাসায় থাকছেন এবং নিয়মিত আসছেন এই অচেনা 'অফিসে'।
কোথায়, কেমন এই পার্টি অফিস?
বাণিজ্যিক ভবনের একটি নির্জন অংশে, সাধারণ অফিস ঘরের মতো দেখতে এই পার্টি অফিসে নেই কোনো পরিচিত চিহ্ন। শেখ হাসিনা বা বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি নেই, এমনকি নেই দলীয় কোনো নামফলকও।
"বঙ্গবন্ধু বা নেত্রীর কোনো ছবি, সাইনবোর্ড কোনো কিছুই আমরা রাখি নি খুবই সচেতন ভাবে। আমরা চাইনি যে এই ঘরটার পরিচিতি প্রকাশ করতে। এমনকি একটা দলীয় দফতরে যেসব ফাইল ইত্যাদি থাকে, সেসবও এখানে রাখা হয় না। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, বৈঠক ইত্যাদির জন্য একটা ঘর দরকার ছিল, এটা পাওয়া গেছে। এটাকে আমরা পার্টি অফিসই বলি, কিন্তু আদতে এটা একটা বাণিজ্যিক অফিস। আগে যে সংস্থা কাজ করত এখানে, তাদেরই ছেড়ে যাওয়া চেয়ার, টেবিল এসবই আমরা ব্যবহার করি," বলছিলেন একজন আওয়ামী লীগ নেতা।
ঘরটির আয়তন আনুমানিক ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফুট। এখানে গাদাগাদি করে ৩০-৩৫ জন বসতে পারেন, তবে বড় বৈঠক হলে ভাড়া নেওয়া হয় কোনো রেস্তোরাঁর হল বা ব্যাংকোয়েট স্পেস। ছোট আলোচনা হয় নেতাদের বাসায়।
কারা যাচ্ছেন এই অফিসে?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই একে একে ভারতে এসেছেন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের বহু নেতা। দলের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ২০০ জনের মতো নেতা কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্য, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা।
অনেকে পরিবারসহ এসেছেন, কেউবা কয়েকজন মিলে ফ্ল্যাট শেয়ার করছেন। পরিবার থেকে কেউ কেউ মাঝেমধ্যে এসে কিছুদিন কাটিয়েও যাচ্ছেন।
"এখন যে সংখ্যাটা খুব বেশী বেড়েছে তা নয়। বর্তমানে দ্বাদশ সংসদের ৮০ জনের মতো সংসদ সদস্য এবং তারও আগে সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন ১০-১২ জন নেতা আছেন এখানে। আবার এমনও কয়েকজন এসেছেন যারা কলকাতায় এসে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশে চলে গেছেন," বলছিলেন এক আওয়ামী লীগ নেতা।
এই নেতাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময়ে গোপন এই পার্টি অফিসে আসেন। তবে কোনো নির্ধারিত সময় নেই, প্রয়োজন অনুযায়ীই হয় বৈঠক। অফিসটি নির্দিষ্টভাবে গোপন রাখার কৌশল হিসাবে রাখা হয়নি কোনো দৃশ্যমান রাজনৈতিক চিহ্ন।
ভার্চুয়ালি চলছে দলের কর্মকাণ্ড
গত এক বছর ধরেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক কাজ চলেছে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও ফেসবুক লাইভে।
শেখ হাসিনা নিজেও মাঝে মাঝে এই অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হন। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও চলে বিশ্লেষণ।
প্রাক্তন সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলেন,
"তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারছি, তাদের মতামত জানতে পারছি, কী করণীয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে পারছি।
এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের। কোনো একটা ব্যবস্থা বদলানোতে এই তরুণ প্রজন্মের বড় ভূমিকা থাকে। আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে তাদের কাছেই পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।"
শেখ হাসিনা ডেকেছিলেন দিল্লিতে
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ৩১ জুলাই দিল্লিতে একটি বৈঠকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ডেকেছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও বৈঠকের বিষয়ে কেউ বিস্তারিত কিছু জানাননি। এই বৈঠক ছাড়া বাকি সব কর্মকাণ্ডই হয়েছে ভার্চুয়ালি।
'ভারত থেকেই চলছে দল'?
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হুসেইন অবশ্য এই ধারণা নাকচ করে বলেছেন,
"এই ধারণাটা ঠিক নয় যে ভারত থেকে দল চলছে। মূল দল বা সহযোগী সংগঠনগুলোর কতজন নেতা-ই বা ভারত অথবা অন্যান্য দেশে রয়েছেন? বেশিরভাগ তো এখনও বাংলাদেশেই আছেন।"
তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ ভারতে থাকায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিকনির্দেশনা এখান থেকেই আসছে, তা অনস্বীকার্য।
বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে দল
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—যখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তখন নেতৃত্ব কেন ভারতে?
প্রাক্তন এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, "এই প্রশ্ন ওঠা যে খুব অযৌক্তিক তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হল, ১৯৭১ এ যদি তখনকার নেতৃত্ব ভারতে চলে এসে প্রবাসী সরকার গঠন না করতেন, তাহলে কী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হত?... আমি ৭১-এর সঙ্গে তুলনা করছি না বর্তমান সময়ের, কিন্তু এরকম উদাহরণ আমাদের দেশেও রয়েছে, অন্যান্য দেশেও আছে...।"
তিনি বলেন, দেশেই থাকলে হয়তো জেলে যেতে হত, এমনকি প্রাণহানির আশঙ্কাও ছিল। ফলে দল পরিচালনার জন্য বিকল্প এই পথই বেছে নিতে হয়েছে।
বর্তমান সরকারকে 'ব্যর্থ' বলছে আওয়ামী লীগ
অবস্থানগতভাবে এখন আওয়ামী লীগ লক্ষ্য রেখেছে অধ্যাপক ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের 'ব্যর্থতা' তুলে ধরায়।
ওবায়েদুল কাদের বলেন, "নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন প্রচার করেছিল এই সরকার, তাতে তারা গত একবছরে সব দিক থেকেই ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতি ফেইল করেছে, বিচারব্যবস্থা প্রহসনে দাঁড়িয়েছে। আর সবক্ষেত্রেই তাদের ব্যর্থতার জন্য তারা শেখ হাসিনা আর ভারতের ওপরে দায় চাপাতে ব্যস্ত। একটা যেন ইন্ডিয়া ফোবিয়া, হাসিনা ফোবিয়া হয়ে গেছে তাদের।"
ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য
নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র লীগের সভাপতি সাদ্দাম হুসেইন গত সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে রয়েছেন। তিনি বলেন,
"গত একবছর ধরে ক্যাম্পাসটা খুব মিস করি... হাজার হাজার ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক তারা তো দেশে থেকেও ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না... শুধুমাত্র তারা আওয়ামী লীগ ঘরানার পরিবারের সন্তান বলে।"
অর্থায়ন চলছে কিভাবে?
ভার্চুয়াল মাধ্যমে কাজ চালানোয় খরচ তুলনামূলক কম, তবে যেসব নেতা ভারতে রয়েছেন, তাদের জীবনযাপনের খরচ আছে। দলীয় নেতারা বলছেন, দেশ-বিদেশে থাকা শুভাকাঙ্ক্ষীরাই অর্থসাহায্য করছেন।
ওবায়েদুল কাদের বলেন, "সাংগঠনিক ভাবে অগাস্টের পরে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেই অন্ধকার অতিক্রম করা কঠিন কাজ... কর্মীরা এখানে কষ্ট করেই আছেন, তবে মনোবলই আমাদের সম্বল।"
পঙ্কজ দেবনাথ জানান, জীবনযাত্রায় বড় রকম পরিবর্তন এসেছে। "আমরা যে এখানে মানবেতর জীবন যাপন করছি, বা ৭১-এর যুদ্ধের সময়ের মতো শরণার্থী শিবিরে থাকছি তা নয়। কিন্তু... আমাদের মধ্যে যাদের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত জীবনযাত্রা ছিল, সে সবই পরিবর্তন করতে হয়েছে।"
তিনি এখন অন্য তিনজনের সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট ভাগ করে থাকেন, গণপরিবহন ব্যবহার করেন এবং ব্যয়ের ওপর কড়াকড়ি নজর রাখেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন স্পষ্টতই বিদেশে অবস্থান করছে, কিন্তু দলের শক্তি ধরে রাখার চেষ্টা চলছে ভার্চুয়ালি, আড়ালে এবং নানা কৌশলে। তবে সামনে কী অপেক্ষা করছে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ওবায়েদুল কাদেরের কথায়, "দিনক্ষণ ঠিক করে ওভাবে তো রাজনৈতিক লড়াই হয় না, আবার লড়াই ছাড়া উপায়ও নেই।"
সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা