
তাইওয়ান ঘিরে টোকিও ও বেইজিংয়ের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এমন সময়ে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর ভাষায় সতর্ক করে জানিয়েছে, তাইওয়ান পরিস্থিতিতে জোরপূর্বক হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে জাপান চীনা সেনাবাহিনীর কাছে ধ্বংসাত্মক পরাজয়ের মুখোমুখি হবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সাম্প্রতিক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দুই দেশের টানাপড়েন গত এক সপ্তাহে আরও তীব্র হয়েছে।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া একটি বিবৃতিতে এই কঠোর হুমকি দেওয়া হয়। টোকিও এ দিন চীনা রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায় একজন উচ্চপদস্থ চীনা কূটনীতিকের অনলাইন পোস্টের প্রতিবাদ জানাতে, যা সম্পর্কের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।
গত সপ্তাহে জাপানের সংসদে তাকাইচি বলেছিলেন, চীন যদি তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালায়, তা জাপানের জন্য “অস্তিত্ব-হুমকির পরিস্থিতি” সৃষ্টি করতে পারে এবং টোকিও প্রয়োজন হলে সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। তার এই মন্তব্যই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বকে জ্বালিয়ে তোলে।
এর পরদিন ওসাকা-ভিত্তিক চীনা কনসাল জুয়ে জিয়ান একটি সংবাদ প্রতিবেদন শেয়ার করে লেখেন, “যে নোংরা গলা সামনে এগিয়ে আসে, তাকে কেটে ফেলা উচিত।” পরে তিনি পোস্টটি মুছে ফেলেন।
জাপান এটিকে “চরম অনুপযুক্ত” বলে কঠোর প্রতিবাদ জানায় এবং চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। দেশটির কিছু রাজনীতিক জুয়েকে বহিষ্কারের দাবিও তুলেছেন, যদিও জাপান সরকার এখন পর্যন্ত কেবল বেইজিংকে “উপযুক্ত ব্যবস্থা” নিতে বলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জিয়াং বিন তাকাইচির বক্তব্যকে “চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বিপজ্জনক” বলে আখ্যা দেন। সতর্কবার্তায় তিনি বলেন, “জাপান যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় বা তাইওয়ান প্রশ্নে শক্তি প্রয়োগ করে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে ইস্পাত-ইচ্ছাশক্তির পিপলস লিবারেশন আর্মির কাছে চূর্ণ পরাজয় বরণ করতে হবে এবং বড় মূল্য দিতে হবে।”
চীন এর আগের দিন জাপানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ক্ঠিন ভাষায় প্রতিবাদ জানায়; গত দুই বছরে যা প্রথম ঘটনা। ২০২৩ সালে ফুকুশিমার দূষিত পানি সমুদ্রে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষবার তলব করেছিল বেইজিং।
চীন জাপানের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নীতি পরিবর্তন নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে টোকিওর অ-পারমাণবিক অবস্থান সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও ভবিষ্যতে পারমাণবিক সাবমেরিন অধিগ্রহণ নিয়ে সম্ভাবনার ইঙ্গিতকে নেতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে বেইজিং।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, জাপানের এই অবস্থান ঐতিহ্যগত নীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে।
চীনা রাষ্ট্র–মাধ্যম সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তাকাইচিকে লক্ষ্য করে ধারাবাহিকভাবে তীব্র সম্পাদকীয় প্রকাশ করছে। চীন-জাপানের যুদ্ধ, ইতিহাস ও তাইওয়ান ইস্যু বেইজিংয়ের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় এসব লেখায় কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেই দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে তাকাইচির সাক্ষাৎ হয়েছিল।
পিপলস ডেইলির এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, তাকাইচির মন্তব্য “অপ্রাসঙ্গিক একক রাজনৈতিক উক্তি নয়।”
‘ঝোং শ্যাঙ’-অর্থাৎ “চীনের কণ্ঠ”-ছদ্মনামে প্রকাশিত মন্তব্যে আরও বলা হয়, জাপানের ডানপন্থীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধানের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে সামরিক শক্তি বাড়ানোর পথ খুঁজছে।
পত্রিকাটি লিখেছে, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপান মাথা গুঁজে সামরিক শক্তি বাড়ানোর পথে ছুটে চলছে। ইয়াসুকুনি মন্দিরে ঘন ঘন সফর থেকে শুরু করে নানজিং গণহত্যা অস্বীকার, ‘চীন-হুমকি তত্ত্ব’ প্রচার- তাকাইচির প্রতিটি পদক্ষেপ অতীতের অপরাধবোধের সেই পুরোনো চিহ্ন অনুসরণ করে, আগ্রাসনের ইতিহাসকে ধুয়ে–মুছে ফেলা এবং সামরিকতাবাদকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার আগে ১৯৩১ সালে জাপানের চীন আক্রমণের স্মৃতি এখনো দু’দেশের সম্পর্কে স্থায়ী উত্তেজনার উৎস হয়ে আছে।
চীন গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত তাইওয়ানকে নিজের অংশ দাবি করে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে থাকে। আর তাইওয়ান বলে, দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কেবল নিজেদের জনগণেরই সিদ্ধান্ত বলবত থাকবে।
তাইওয়ান জাপানি ভূখণ্ড থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরে; এর চারপাশের সমুদ্রপথ জাপানের বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে জাপানেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিদেশি সামরিক ঘাঁটি।
জাপানি সম্প্রচারক এনটিভির তথ্য অনুযায়ী, চীন-বিরোধী মনোভাব বাড়তে পারে আশঙ্কায় টোকিওতে চীনা দূতাবাস কর্মীদের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক ব্রিফিংয়ে জাপান সরকারের প্রধান মুখপাত্র মোরিনোরি কিহারা জানিয়েছেন, জাপানের অবস্থান অপরিবর্তিত এবং দেশটি তাইওয়ান প্রশ্নে শান্তিপূর্ণ সংলাপকেই সমাধানের পথ হিসেবে দেখে।