
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ছয়টি সৌর প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে- এমন তথ্য প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)। আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পরিচালিত ছয়টি সৌর প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গড়ে ৮ কোটি টাকা প্রয়োজন, কিন্তু এই ছয়টি প্রকল্পে প্রতি মেগাওয়াট গড়ে ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পগুলিতে ২,৯২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি টিআইবির কর্মকর্তা নেওয়াজুল মওলা ও আশনা ইসলাম উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পগুলিতে ৪,০৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন, কিন্তু ৬,৯৭০ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি জমিতে স্থাপিত প্রকল্পগুলোতেও (ভূমি অধিগ্রহণ ও ইজারার বিষয় না থাকা সত্ত্বেও) প্রতি মেগাওয়াট ব্যয় ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, বিদ্যুৎখাতের ৫টি প্রকল্পে শুধু ভূমি ক্রয় ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ২৪৯ কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
বিদ্যুৎখাতে বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ৩.৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রক্রিয়াগত অস্পষ্টতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের ‘লেটার অব ইন্টেন্ট (এলওআই)’ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কর প্রণোদনা, শুল্ক ও ভ্যাট ছাড়, বিমা প্রণোদনা তুলনামূলকভাবে খুবই সীমিত।
গবেষকরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ৩,২৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩১টি আনসলিসিটেড নবায়নযোগ্য প্রকল্পের এলওআই বাতিল করেছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্পে জমি ক্রয় ও কর প্রদানসহ অফেরতযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। ৪টি প্রকল্পে বিদেশি কোম্পানির সরাসরি বিনিয়োগ আছে, যার ২টির শতভাগ মালিকানা বিদেশি কোম্পানির।
নতুনভাবে ৫৫টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, তবে এর মধ্যে ২২টিতে কেবল একটি করে দরপত্র এসেছে এবং ১৩টিতে কোনো দরপত্রই আসেনি। ‘রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি’ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি সীমিত।
টিআইবি জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন ফাইন্যান্সিং স্কিম থাকলেও জটিল প্রক্রিয়া ও নানা কারণে কার্যকর ব্যবহার সীমিত। এছাড়া, দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্তৃত এলাকা ব্যবহার করে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন সম্ভব, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বিনিয়োগের ঘাটতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থা যেমন এডিবি ও বিশ্বব্যাংক, সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতের নবায়নযোগ্য প্রকল্পে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী, যার ফলে সরকারি খাতের ভূমিকা সীমিত। সরকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ না দেয়ায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কম।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিদ্যুৎখাতে নীতি সংক্রান্ত অসঙ্গতি ও দুর্নীতি স্পষ্ট। নবায়নযোগ্য খাতকে প্রাধান্য না দেওয়া, জীবাশ্ম জ্বালানিতে অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং স্বচ্ছতার অভাব দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। বর্তমান অবস্থায় ২০৫০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৯৫ শতাংশ, আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর মাত্র ৪ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য খাত সবসময় অবহেলিত হয়েছে।”