
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর পেরিয়ে গেছে দুই সপ্তাহ, তবে মামলার সংখ্যা ও অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জেলার চারটি থানায় দায়ের হওয়া ১৫ মামলায় এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে আসামি করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা হিসেবে দেখানো হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার জনকে।
সর্বশেষ ৩০ জুলাই সদর থানায় করা এক মামলায় ৪৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৫ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। বাদী ছিলেন সদর থানার পরিদর্শক মো. মতিয়ার মোল্লা। ওই মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও আসামির তালিকায় রয়েছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
১৬ জুলাই এনসিপির কর্মসূচিতে সহিংসতা শুরু হলে এতে পাঁচজন নিহত হন এবং অন্তত ৫০ জন আহত হন। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে সদর, টুঙ্গিপাড়া, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায় মোট ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়। অধিকাংশ মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা।
মামলাগুলোর ধরন ও দীর্ঘ সময় পরও নতুন করে মামলা দায়ের করা এবং বিপুল সংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি যুক্ত করার ঘটনায় প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা। অনেকে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হয়রানিমূলক প্রক্রিয়া বলেও মনে করছেন।
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “ঘটনার দিন কয়েক হাজার লোক অংশ নেয়। পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য মাধ্যমে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।” তিনি জানান, সর্বশেষ মামলায় পাঁচ হাজার অজ্ঞাত আসামি আসলে পূর্বের মামলাগুলোর সম্মিলিত রূপ।
টুঙ্গিপাড়া থানার একটি মামলায় ৮২ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ২০০ জনকে অজ্ঞাত দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে কোটালীপাড়ায় দায়ের করা মামলায় ১৫৫ জন নামীয় আসামি ছাড়াও দেড় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এত অজ্ঞাত আসামি যুক্ত করা উদ্বেগজনক এবং ভবিষ্যতে নিরীহ নাগরিকদের হয়রানির আশঙ্কা থেকেই যায়। তারা এ বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ঘটনার অনেক দিন পর এত বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি করা নজিরবিহীন ও বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য হুমকিস্বরূপ। তদ্বির কমিশনের কার্যক্রম নিয়েও জনমনে সন্দেহ রয়েছে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ায়, সংঘর্ষের পরপরই জারি করা হয় ১৪৪ ধারা ও কারফিউ। একাধিক ধাপে কারফিউ বাড়িয়ে অবশেষে ২০ জুলাই তা প্রত্যাহার করা হয়। এখন পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এনসিপির অভিযোগ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা সমাবেশে হামলা চালায়, যার জেরে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের দাবি, ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ।
সর্বশেষ মামলার এজাহারে বলা হয়, সরকারবিরোধী কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো, সরকারি কাজে বাধা ও ককটেল নিক্ষেপের মতো হামলা চালানো হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন উঠছে—অপরাধীদের বিচারে স্বচ্ছতা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কতটা আন্তরিকভাবে পালন করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের চিহ্নিত করার চেয়ে, ‘অজ্ঞাত’ তালিকার মাধ্যমে একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কিনা, সেটিই এখন ভাবনার বিষয়।