
রাজনীতির আলোচনায় যাঁর নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে, তাঁর পাশে সবসময় ছিলেন এক অচেনা মুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই নীরব সঙ্গীর নাম ফাতেমা বেগম। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন এই গৃহকর্মী, যাঁকে ঘিরে একসময় কটাক্ষও করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, “কারাগারেও তাঁর (খালেদা জিয়ার) ফাতেমাকে লাগবে।”
রাজনৈতিক ইতিহাসে নেতৃত্ব, আন্দোলন আর ক্ষমতার গল্প যতটা আলোয় আসে, ততটাই আড়ালে থেকে যায় কিছু মানুষের অবদান। খালেদা জিয়ার জীবনে সেই নীরব উপস্থিতি ছিলেন ফাতেমা বেগম। প্রকাশ্য মঞ্চ নয়, বরং ছায়ার ভেতর থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে গৃহকর্মীর সীমা ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন খালেদা জিয়ার একান্ত সহচর। কারাবাসের দিন, গৃহবন্দিত্বের দীর্ঘ সময়, হাসপাতালের নিঃসঙ্গ রাত কিংবা বিদেশ সফরের নিরব করিডর, সবখানেই নিঃশব্দে তাঁর উপস্থিতি ছিল।
কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা দলীয় পদ না থাকলেও সংকটের মুহূর্তে তাঁর ভূমিকা ছিল অনিবার্য। দায়িত্ব আর মানবিকতার জায়গা থেকেই তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন খালেদা জিয়ার জীবনের প্রতিটি কঠিন অধ্যায়ে।
ফাতেমা বেগমের জন্ম ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রামে। বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মালেকা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। অল্প বয়সেই সংসারের ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে।
একই ইউনিয়নের কৃষক মো. হারুন লাহাড়ির সঙ্গে বিয়ের পর মেঘনার চরে কৃষিকাজ করেই চলছিল সংসার। তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। কিন্তু ২০০৮ সালে, যখন ছেলের বয়স মাত্র দুই বছর, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তাঁর স্বামী। মুহূর্তেই বদলে যায় জীবনের সব হিসাব।
স্বামী হারানোর পর দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে যান বাবার বাড়িতে। মুদি দোকানি বাবার সামান্য আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখনই সন্তানদের গ্রামে রেখে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
২০০৯ সালে পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি কাজ পান খালেদা জিয়ার বাসভবনে। সেখান থেকেই শুরু হয় দীর্ঘ এক সহযাত্রা। দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক নেত্রীর দৈনন্দিন জীবনের নীরব সঙ্গী হয়ে ওঠেন ফাতেমা।
শারীরিক অসুস্থতায় বাথরুমে যাওয়া-আসায় সহায়তা, নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো কিংবা দুর্বল মুহূর্তে হাত ধরে রাখা, এসব কাজ তাঁর কাছে ছিল কেবল দায়িত্ব নয়, বরং সম্পর্কের এক গভীর দায়বদ্ধতা।
২০১৪ সালের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির সময় গুলশানের বাসভবনের সামনে বালুভর্তি ট্রাক রেখে পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাড়িতে উঠেও বেরোতে না পেরে ফিরোজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া। পুলিশের চাপ আর শারীরিক দুর্বলতায় তিনি তখন ভারসাম্য হারাচ্ছিলেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে তাঁর হাত ধরে রাখেন ফাতেমা। ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে যায় সেই দৃশ্য, রাজনীতির উত্তাপের ভেতর মানবিকতার এক স্থির ছবি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতের রায়ে খালেদা জিয়াকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তখন তাঁর আইনজীবীরা আবেদন করেন, গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম যেন তাঁর সঙ্গে থাকতে পারেন।
আদালতের অনুমতিতে ছয় দিন পর ফাতেমা কারাগারে প্রবেশ করেন। কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই স্বেচ্ছায় তিনি বন্দিজীবনে যুক্ত হন, কারণ তিনি জানতেন, এই সময়ে একা থাকা মানে ভেঙে পড়া।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। সে সময় ৫৩ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে। যখন মানুষ আপনজনের কাছেও যেতে ভয় পাচ্ছিল, তখন ফাতেমা ছিলেন অবিচল। সেবিকা, সাহস আর ছায়া হয়ে তিনি সবসময় পাশে থেকেছেন।
সর্বশেষ লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার সময়ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। এর আগেও একাধিকবার বিদেশ সফরে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন তিনি। কোথাও তাঁর নাম আলোচনায় আসেনি, কোনো বক্তব্যও দেননি। তবু ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে তাঁর নীরব ছায়া রয়ে গেছে।
ফাতেমা বেগম দেখিয়ে দিয়েছেন, সব সম্পর্ক ক্ষমতার নয়। কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে দায়িত্ব আর মানবিকতার বন্ধনে। রাজনীতির কোলাহলের ভেতরে তিনি এক নীরব নাম, আর সেই নীরবতাই তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে।