
কক্সবাজারে মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার মামলায় দোষীদের এখনো ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তিনি বলেছেন, “একজন মেজরকে গুলি করে হত্যা করা হলো, কিন্তু দোষীদের এখনও পর্যন্ত ফাঁসি হয়নি। কেন হয়নি, কেন হলো না এ বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে।”
বুধবার (১২ নভেম্বর) রাজধানীর মহাখালীতে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) আয়োজিত, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর মুহাম্মদ আবদুল গণির ৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে; আলোচনা ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
অলি আহমদ বলেন, “মেজর গনির অবদান পাঠ্যপুস্তকে থাকা উচিত ছিল। দেশে অনেকেই স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন, কিন্তু বীর সন্তানেরা স্বাধীনতা পদক পাননি। আমরা নাটক, সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত, কিন্তু ভালো জিনিস গ্রহণ করি না।”
তিনি আরও বলেন, “পৃথিবীতে যত বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে, সবই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এসেছে। সিভিলিয়ানদের ভূমিকা এখানে নেই। আমরা চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, আমেরিকার দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেজর গনির জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি রাওয়াকে বলেন, “এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”
অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, “তৎকালীন রেজিমেন্টে বাঙালিদের জন্য আলাদা কোনো রেজিমেন্ট ছিল না। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান, বিহারসহ একাধিক গোষ্ঠীর রেজিমেন্ট ছিল। পরে বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে মেজর গনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কেবল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি; তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করতে নিজে মাঠে কাজ করেছেন। সেই সময়ে বাঙালি তরুণদের মনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া মানেই মৃত্যু; এমন ভয় ছিল। এই ভীতি দূর করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন মেজর গনি, এবং এই প্রচেষ্টায় তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনও পেয়েছিলেন।”
তিনি আরও জানান, ১৯৪৮ সালের ২০ মার্চ কুর্মিটোলায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশংসা করেছিলেন।
মেজর গনির বড় ছেলে কর্নেল (অব.) তাজুল ইসলাম বলেন, “নতুন প্রজন্মের বোঝা উচিত, আমাদের অতীতকে জানতে হবে। মেজর গনি একজন নির্ভেজাল মানুষ ছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই নেতৃত্বের গুণ ছিল তার মধ্যে। তিনি দেশকে এবং দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।”
সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বলেন, “সেনা ছাওনি থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে, এবং তা এসেছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে। বর্তমান সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেনাবাহিনী মেজর গনিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনি। একজন সিভিলিয়ান হিসেবে আমি বলব, তার নামে বড় কোনো কিছু করা হয়নি। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে তার নামে কিছু করার কথা ছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।”
সভাপতির বক্তব্যে রাওয়ার চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল হক বলেন, “মেজর গনি মানে এক অগ্নিঝরা নাম। বর্তমান যুব সমাজের জন্য তিনি প্রেরণার বাতিঘর। তিনি এক জীবন্ত ইতিহাস। তার আদর্শকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন রাওয়ার সেক্রেটারি লে. কর্নেল (অব.) মো. ইরশাদ সাইদ, মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম, ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহজালাল ও মেজর (অব.) জামাল হায়দার প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বাহিনী গঠনের পেছনে মেজর এম. এ. গনির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ১ ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার নাগাইশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। খুলনায় মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে পড়াশোনা ছেড়ে কলকাতার বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ৮ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে ৮ আগস্ট পদাতিক বাহিনীতে নিয়োগ পান। এরপর ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোরের অধীনে ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্ব তীর থেকে বার্মার দক্ষিণে আকিয়াব পর্যন্ত যুদ্ধ পরিচালনা করে শত্রুপক্ষের আগ্রাসন প্রতিহত করেন।
১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেদিন রেজিমেন্টের অফিসাররা ঘোষণা দেন, “বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলব না”, যা ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।
পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারদের বৈরী আচরণের কারণে মেজর গনি ১৯৫৩ সালের ৬ নভেম্বর অব্যাহতি নেন। পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ভেটেরান্স কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়ে ১১ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসে সমাহিত করা হয়।