
উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে এমন এক বড় অস্ত্রচুক্তিতে পৌঁছেছে পাকিস্তান। চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি যুদ্ধবিমানসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) সঙ্গে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সমঝোতা করেছে ইসলামাবাদ- এমন তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
চুক্তিটি কার্যকর হলে লিবিয়ার সামরিক বাস্তবতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে দেশটির পূর্বাঞ্চল হাফতারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পশ্চিমাঞ্চলে ত্রিপোলিভিত্তিক জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দিবেইবা।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে বেনগাজি সফরে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির হাফতারের ছেলে সাদ্দামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সফরেই অস্ত্রচুক্তিটি চূড়ান্ত হয়। লিবিয়ান কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে মুনির বলেন, ‘আপনাদের সশস্ত্র বাহিনীকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী করুন। কারণ সশস্ত্র বাহিনীই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে।’

লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এক ভিডিও ভাষণে তিনি আরও বলেন, ‘লিবিয়া বীরদের ভূমি।’ এ সময় তিনি লিবিয়ার ইসলামি চিন্তাবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ওমর আল-মুখতারের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন, যিনি ১৯২০ ও ৩০-এর দশকে ইতালীয় দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তার জীবনসংগ্রাম নিয়ে ১৯৮১ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘লায়ন অব দ্য ডেজার্ট’।
রয়টার্সের দেখা চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, হাফতারের বাহিনী পাকিস্তান-চীন যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ১৬টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান এবং প্রাথমিক পাইলট প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত ১২টি সুপার মুশাক প্রশিক্ষণ বিমান কিনবে। রয়টার্সকে উদ্ধৃত এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা জানান, আড়াই বছরে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হবে এবং এতে স্থল, নৌ ও আকাশপথে ব্যবহারের বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে। দুই পাকিস্তানি কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, চুক্তির মোট মূল্য সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানি চুক্তি।
বর্তমানে ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার কিংবা হাফতারের বাহিনী—কোনো পক্ষেরই শক্তিশালী আকাশবাহিনী নেই।
২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর ও রাশিয়ার সমর্থনে হাফতার ত্রিপোলি দখলের ব্যর্থ চেষ্টা চালান। সে সময় তুরস্ক ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারকে রক্ষায় ভাড়াটে যোদ্ধা ও টিবি২ ড্রোন পাঠিয়ে হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তীতে তুরস্ক পশ্চিম লিবিয়ায় হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করে এবং ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে একটি বিতর্কিত সামুদ্রিক চুক্তিতে যায়।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০২১ সালে নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আবদুল হামিদ দিবেইবাকে প্রধানমন্ত্রী করা হলেও নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং তিনি ত্রিপোলি নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী মিলিশিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
২০১১ সালে ন্যাটোর নেতৃত্বে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে লিবিয়া উপসাগরীয় দেশগুলো ও তুরস্কের প্রক্সি সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই বিভাজন অনেকটাই ঝাপসা হয়েছে।
লিবিয়ার বদলে যাওয়া মিত্রতা
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। অন্যদিকে তুরস্ক হাফতারের ছেলে ও সম্ভাব্য উত্তরসূরি সাদ্দামের মাধ্যমে হাফতারের সঙ্গে যোগাযোগ জোরদার করছে। চলতি বছরের শুরুতে খলিফা হাফতারের তুরস্ক সফরের আলোচনা হলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
ইসলামাবাদের সঙ্গে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। হাফতারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় মিত্র আমিরাত হলেও সৌদি আরবও তাকে সমর্থন দিয়েছে এবং তার পক্ষে লবিং করেছে। মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিয়াদে রাশিয়ার দূতাবাস একসময় মস্কোর সঙ্গে হাফতারের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।
তবে সুদানের সংঘাতকে ঘিরে হাফতার পরিবারের অবস্থানের কারণে মিসরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে সমর্থন ও সমন্বয় করেছে হাফতারের বাহিনী।
লিবিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সুদানের দারফুর অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে আরএসএফকে অস্ত্র পাঠাতে হাফতার সহায়তা করেছে বলেও মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে। জুন মাসে আরব কর্মকর্তারা বলেন, হাফতারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহিনী আরএসএফের সঙ্গে যৌথভাবে সীমান্ত পেরিয়ে সুদানি সেনাবাহিনীর অনুগত বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, যাদের মিসর সমর্থন দেয়।
হাফতারের কাছে পাকিস্তানের অস্ত্র বিক্রি দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। উপসাগরীয় দেশগুলো এ চুক্তিতে খুব একটা উদ্বিগ্ন না হলেও তুরস্কের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হতে পারে। পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান বিরোধে আঙ্কারা ইসলামাবাদের পক্ষে অবস্থান নেয়। তুরস্ক পাকিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী, যদিও সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী চীনের তুলনায় তা অনেক কম।
পাকিস্তানের বাড়তি সক্রিয়তা
অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তান অস্ত্র রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মে মাসে ভারতের সঙ্গে সীমান্তে প্রাণঘাতী সামরিক সংঘাতে নিজেদের সামরিক সরঞ্জামের কার্যকারিতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে আগ্রহ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি।
২০১১ সাল থেকে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকলেও লিবিয়ায় বছরের পর বছর ধরে অস্ত্র প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে।
চীনা অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর দুই দেশের যোগাযোগ বেড়েছে। গত অক্টোবরে মিসরে গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে এক অনুষ্ঠানে সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তব্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন।
পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিবেচিত সেনাপ্রধান আসিম মুনির চলতি বছরে দু’বার ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি তৃতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউস সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।