গাজায় প্রাণঘাতী হামলার কারণ জানাল ইসরায়েলি সেনারা
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৮:১১ পিএম, ২৭ জুন ২০২৫

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণসহায়তা নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছেন মানুষ। কোনো ধরনের হুমকি না থাকলেও ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে ইসরায়েলি সেনাদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
শুক্রবার (২৭ জুন) এক প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ। অভিযানে থাকা সেনাসদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি করেছে হারেৎজ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সেনাসদস্য জানিয়েছেন, তিনি যে এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে প্রতিদিন সেনাবাহিনীর গুলিতে এক থেকে পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। তার তথ্যমতে, ভিড় নিয়ন্ত্রণের মতো খুবই ছোট ইস্যুগুলোকে সামলাতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। ‘যদিও তারা কোনো হুমকি তৈরি করে না। গুলি না চালিয়েও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এটা নিঃসন্দেহে হত্যাকাণ্ড,’ বলেন তিনি।
গত এক মাসে গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে ৫৪৯ ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে। এরপরই এ বিষয়ে মুখ খোলেন ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির পর এই তথ্য ফাঁস হয়, যেখানে বলা হয়, গত ২৭ মে থেকে বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কেন্দ্র ও জাতিসংঘের খাদ্য সরবরাহকারী ট্রাকের আশপাশে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৫৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং ৪ হাজার জনের বেশি আহত হয়েছেন।
এক রিজার্ভ সেনাসদস্য বলেন, ‘আমরা আর গাজায় যুদ্ধ করতে আগ্রহী নই। এটি এমন এক স্থান হয়ে উঠেছে, যেখানে মানুষের জীবনের কোনো দামই নেই!’
এ ছাড়া এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হারেৎজকে বলেন, ‘যেসব সৈন্য গুলি চালিয়েছে, তাদের কাছে আমরা কৈফিয়ত চেয়েছি যে কেন গুলি চালানো হলো? উত্তর ছিল, ‘ওপরের নির্দেশ’। আমি দেখেছি যে, নিহত মানুষগুলো সেনাদের খুব কাছেও ছিল না, তাদের হুমকি বলে গণ্য করার কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। তবু তাদের হত্যা করা হয়েছে। এটা একেবারে অকারণে। এসব হত্যা এখন যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে!’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবার আমরা গুলি চালাই, হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে কেন একটি শেল প্রয়োজন, তখন কোনো ভালো উত্তর পাওয়া যায় না।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনী এমন নৃশংস কর্মকাণ্ডকে ‘ভীতি প্রদর্শনের কৌশল’ বলে চালিয়ে দেয়। মর্টার শেল, ট্যাংক, এমনকি মেশিনগান ব্যবহার করেও ত্রাণ সংগ্রহকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে।
সেনাদের ভাষ্যমতে, এসব অভিযানের একটি অপারেশনাল নাম রয়েছে, ‘অপারেশন সল্টেড ফিশ’, যা শিশুদের খেলা ‘রেড লাইট, গ্রিন লাইট’-এর (বাংলাদেশের এলন্টি-বেলন্টি বা লণ্ঠন খেলা) ইসরায়েলি সংস্করণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দৈনিকটি আরও জানায়, এই অভিযোগগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং অ্যাসেসমেন্ট মেকানিজম’ কিছু ঘটনাকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের আওতায় আসা ইউনিটগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিভিশন ২৫২, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইহুদা ভাখ।
হারেৎজ জানায়, জাতিসংঘের ত্রাণসহায়তা ট্রাকের পাশে জড়ো হওয়া নিরস্ত্র বেসামরিকদের ওপর গুলি চালাতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন এই জেনারেল। তবে কর্মকর্তাদের মতে, বাস্তবে এই তদন্তগুলো অর্থহীন ও কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
এক আইনি সূত্র হারেৎজকে বলেছে, ‘এটা শুধু কয়েকজন নিহত হওয়ার বিষয় নয়। প্রতিদিন এখানে ডজন ডজন মানুষ হতাহত হচ্ছে। অথচ বাস্তবে তদন্তের কোনো গতি নেই, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নেই।’
এক সেনাসদস্য বলেন, ‘এই নীতিকে কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে যে মানসিকতাটা কাজ করে, তা হলো, ফিলিস্তিনিদের সরাতে হবে, এমনকি তারা শুধু খাবারের জন্য এলেও।’
গাজায় নিয়োজিত ঠিকাদাররা এই সংকট আরও ঘনীভূত করছে বলেও উঠে আসে সেনাদের বক্তব্য অনুযায়ী। তাদের কার্যক্রম প্রায় নজরদারি ছাড়াই চলছে। একজন সেনাসদস্য বলেন, ‘প্রতিটি বাড়ি ভাঙার জন্য গাজায় কাজ করা ঠিকাদাররা পাঁচ হাজার শেকেল (প্রায় ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) করে পাচ্ছে।’