ভোর থেকে লাইন আটার জন্য


ভোর থেকে লাইন আটার জন্য

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে ওএমএস-এর (ওপেন মার্কেট সেল) স্বল্পমূল্যের আটা পেতে সূর্য ওঠার আগেই লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও ভিড়ের মুখেও সবাই আটা পাচ্ছেন না, বরং হতাশ হয়ে ফিরছেন অনেকেই।

ভোর পাঁচটা। কুয়াশার চাদর সেভাবে সরেনি এখনও। তবু সাদুল্লাপুর উপজেলা পরিষদের সামনে মেসার্স শাহীন ট্রেডার্সের দোকানে জমেছে মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যেই রয়েছেন জামুডাঙ্গা গ্রামের রহিমা বেগম। তিনি বললেন, “সবার আগোত নাইনোত (আগে লাইনে) না খাড়া (দাঁড়) হলে আটা পাওয়া যায় না। সে জন্য শেষ আইতোত (ভোররাতে) আসি এটাই (এখানে) খাড়া হয়া আছোম (আছি)। বেশি মানুষের ভিড়ের কারণে আগে আসা নাগে।”

জামুডাঙ্গা থেকে প্রতিবেশী এক নারীর সঙ্গে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে রহিমা এসেছেন স্বল্পদামি আটার আশায়। তাঁর দুঃখের সুর, “আমন ধান কাটা-মাড়াই না হওয়া পর্যন্ত হামার (আমার) কষ্ট দূর হবার নয়। তাই এদানকরিই সংসার চালানো নাগবে (লাগবে)। হামার অভাবী কপালে বোধায় এগুলাই নেকা আছে।”

তবে শুধু রহিমা নন, এমন ভোরবেলা আসা মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি। অথচ তাঁদের সবাইকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। কারণ, প্রতিদিন বরাদ্দ থাকে মাত্র ৫০০ কেজি, যা পাঁচ কেজি করে মাত্র ১০০ জনকে দেয়া সম্ভব। ডিলার শাহীন সিদ্দিকী বলেন, “মানুষ চাহিদা মতো আটা না পেয়ে আমাদের গালমন্দ করেন। কিন্তু বরাদ্দ তো আমাদের হাতে নেই। সেটি সরকারিভাবেই আসে।”

সাদুল্লাপুর উপজেলার খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, এখানকার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র একটি, বনগ্রাম ইউনিয়নে, ওএমএস-এর আটা বিক্রি হচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক তিনটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও এই সেবা নেই। ফলে সব ইউনিয়নের মানুষ আটা কিনতে শহরমুখী হচ্ছেন, বাড়িয়ে তুলছেন ভিড়।

বাজারে এক কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। আর ব্র্যান্ডেড প্যাকেটজাত আটার দাম ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। সেখানে ওএমএস আটা মাত্র ২৪ টাকা কেজি দরে মিলছে, যা থেকে পরিষ্কার কেন এত ভিড়।

রাসেল কনফেকশনারির বিক্রয়কর্মী হোসেন আলী জানালেন, শুধু দরিদ্র নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও নিয়মিত আসছেন কম দামে আটা কিনতে। ফলে ডিলারদের চাপ বাড়ছে কয়েকগুণ।

তিন দিন আগে একবার পাঁচ কেজি আটা পেলেও এবার এসে খালি হাতে ফিরেছেন জয়েনপুর গ্রামের সাহেরা বেগম। তিনি বলেন, “এখন হাট থেকে বেশি দামে আটা কিনতে হবে। আমার বাড়িওয়ালার (স্বামীর) হাতে এখন কাজ নেই। তাই বাড়তি দামে আটা কিনতে আমাদের জন্য অনেক কষ্ট হবে।”

ধাতেরহাট সড়কের ডিলার সুফিয়ান ট্রেডার্সের মালিক আবু সুফিয়ান জানালেন, “নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আটা বিক্রি করার কথা থাকলেও, ভোরেই এত মানুষ আসেন যে, ৪০-৫০ মিনিটেই বরাদ্দ ফুরিয়ে যায়।” ফলে বহু মানুষকে ফেরত পাঠাতে হয়।

শাহীন ট্রেডার্সের মালিক শাহিন আল পারভেজ বলেন, “ডিলার পয়েন্ট ছাড়াও ক্রেতারা সকাল থেকে আমাদের বাড়িতে গিয়ে ভিড় করেন। এতে বাড়ির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।”

ওএমএস আটা বিক্রির তদারকি করেন ট্যাগ অফিসাররা। তাঁদের একজন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বললেন, “প্রতিদিন প্রতি পয়েন্টে চার-পাঁচশ মানুষ আসেন। চাহিদা থাকে পাঁচ-ছয় টনের, অথচ বরাদ্দ থাকে মাত্র ৫০০ কেজি। তখন মানুষ ক্ষিপ্ত হন, আমাদের নানা রকম কথা শুনতে হয়।”

সাদুল্লাপুর সরকারি খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা শিহাবুন সাকিব জানিয়েছেন, “ওএমএসে ভালো মানের আটা দেওয়া হচ্ছে। ডিলাররা ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে প্রতিজন ক্রেতার কাছে পাঁচ কেজি করে আটা বিক্রি করছেন। অনিয়মের সুযোগ নেই। বরাদ্দ অনুযায়ী সব ক্রেতাই আটা পাচ্ছেন।”

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আফান আলী বলেন, “মাসে ২০ কার্যদিবসে আটা বিক্রি করা হয়। দিনে দুই ডিলার এক টন আটা বিক্রি করেন। এই বরাদ্দ স্থানীয় চাহিদার তুলনায় খুব কম। আমাদের কিছু করার নেই। সরকার চাইলে বরাদ্দ ও পয়েন্ট বাড়ানো যাবে।” তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে, নির্দেশনা এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওএমএস ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম বলেন, “প্রাথমিক অবস্থায় শুধু শহরতলিতে ওএমএস-এর আটা বিক্রি হচ্ছে। তাই শহরে মানুষের ভিড় বাড়ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে বিক্রির পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×