
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে নির্বাচনের এই প্রস্তুতির মধ্যেই দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে বলে একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচন ঠেকাতে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এজন্য প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম আনা হচ্ছে- যা নির্বাচনের সময় সহিংসতায় ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনে অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনী ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৪টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড গুলি, ২.৩৮৭ কেজি গানপাউডার এবং ২.২২৮ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করে।
সেনাবাহিনীর মতে, এসব অস্ত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকেছিল, যা দিয়ে ককটেল ও হাতবোমা তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল।
গত ২৯ অক্টোবর যমুনায় অনুষ্ঠিত প্রথম সমন্বয় সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, “ছোট শক্তি নয়, বড় শক্তি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করতে পারে। হঠাৎ আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে।”
জুলাই আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেন। তার অনুসারী বহু নেতা-কর্মীও সেখানেই অবস্থান করছেন। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, সেখান থেকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং ডিসেম্বর মাসে দেশে বড় ধরনের শোডাউনের পরিকল্পনা চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনের সময় সারাদেশে ৫ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি গোলাবারুদ লুট হয়েছিল। এর মধ্যে এখনো ১ হাজার ৩৪২টি অস্ত্র ও ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮৭টি গুলি উদ্ধার হয়নি। পুলিশ লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করলেও অগ্রগতি ধীর।
ডিএমপির তথ্য বলছে, গত তিন মাসে রাজধানীতে ২০০টিরও বেশি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযানে ককটেল, দেশি-বিদেশি অস্ত্র ও বিস্ফোরক জব্দ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সহায়তায় কক্সবাজার ও টেকনাফ হয়ে অস্ত্র প্রবেশ করছে। এই চোরাচালানে রোহিঙ্গা চক্রের সক্রিয় সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বিজিবি জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১১৪টি অস্ত্র, ১,৭২৫ রাউন্ড গুলি, ৩৯টি ম্যাগাজিন, ৯টি মর্টারশেল ও ১১টি গ্রেনেড জব্দ করেছে। এর মধ্যে দুটি এসএমজি, ১২টি রাইফেল ও ৩৬টি পিস্তল রয়েছে।
বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে কিছু অস্ত্র প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে, তবে সেটির পরিমাণ এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং গত তিন মাসে ২২টির বেশি অস্ত্রের চালান আটক করা হয়েছে।”
মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, “প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু নির্বাচনি পরিবেশ নয়, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।”
তিনি আরও বলেন, “এমন সময়ে সীমান্তে নজরদারি, র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযান বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও সাধারণ নাগরিকদেরও সতর্ক থাকতে হবে, যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনো বিদেশি স্বার্থের বলি না হয়।”
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। যে কেউ নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”