
গত বছরের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশের পুলিশ বাহিনীতে শুরু হয় বড় ধরনের অস্থিরতা। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা, বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে, কর্মস্থল ত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যান।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৮১ জন পুলিশ সদস্য পলাতক রয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা, ডিআইজি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত। এদের মধ্যে মাত্র ১৫ জনের অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। বাকি সদস্যদের দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়ে জাতীয় কেন্দ্রীয় ব্যুরো (এনসিবি) ইন্টারপোলের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করলেও এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
পলাতকদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার এবং ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের উডল্যান্ড শহরে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জানায়, তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। মনিরুল ইসলামও একই দেশে রয়েছেন। হাবিবুর রহমান অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যে, আর প্রলয় কুমার জোয়ারদার ও সৈয়দ নুরুল ইসলামের অবস্থান ভারত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. বাহারুল আলম বলেন, “জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত অনেক পুলিশ সদস্য বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। দেশে যারা আছেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যাদের অবস্থান শনাক্ত হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।”
এক পুলিশ সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই কর্মকর্তারা দলীয় স্বার্থে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন। বর্তমানে বিদেশে থেকেও তারা সরকারবিরোধী সাবেক নেতাদের সহায়তায় দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যেন ভবিষ্যতে অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসার সুযোগ পান।
অভ্যুত্থানের পর পুলিশের বিরুদ্ধে মোট ১ হাজার ৪৯০টি মামলা দায়ের হয়েছে। দেশজুড়ে অন্তত ১৩৭ পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এদের মধ্যে ৫৬ জন ইতিমধ্যে ফিরে এলেও ৮১ জন এখনও আত্মগোপনে। এ পলাতকদের মধ্যে রয়েছেন ৩ জন ডিআইজি, ১০ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ১১ জন পুলিশ সুপার, ৯ জন অতিরিক্ত এসপি, ৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ২৭ জন পরিদর্শক, ৮ জন এসআই, ৩ জন এএসআই এবং ৫ জন কনস্টেবল।
এছাড়া, গত ৭ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ৪০ জন কর্মকর্তা, ডিআইজি থেকে পরিদর্শক পর্যায় পর্যন্ত; বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি, তাদের পূর্বে প্রাপ্ত পদকও বাতিল করা হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী, কর্মস্থল থেকে পলায়ন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইতোমধ্যে অনেক পলাতক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত এক বছরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে পুলিশের ৮৬ জন কর্মকর্তাকে অন্য ইউনিটে বদলি, ৮২ জনকে ওএসডি এবং ৫৫ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, পলাতকদের শনাক্তকরণ এবং দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, “দেশজুড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে করা অনেক মামলা অত্যন্ত সাধারণ এবং ঢালাওভাবে দায়ের করা হয়েছে। এতে অনেক নিরপরাধ কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যা বাহিনীর মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।” তিনি মনে করেন, এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।