
রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে এক আনুষ্ঠানিক আয়োজনে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘোষণাপত্রকে ‘ঐতিহাসিক দলিল’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রণীত।
ঘোষণাপত্রে ২৮টি ধারায় তুলে ধরা হয়েছে—বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট, এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো ও শাসনব্যবস্থার রূপরেখা।
প্রথমেই বলা হয়েছে, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার।
তবে ঘোষণায় অভিযোগ করা হয়েছে, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক চেতনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় এবং একদলীয় বাকশাল শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’-এর মাধ্যমে শেষ হয়।
পরে আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নয় বছর ধরে চলা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১/১১ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করা হয়। এরপর গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ফ্যাসিবাদী ও অগণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এ সময় সংবিধান পরিবর্তন, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের অধিকার হরণ, বিরোধীদের নিপীড়ন, অর্থনৈতিক দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, এবং জলবায়ু ও পরিবেশ ধ্বংসের মতো অভিযোগও উত্থাপন করা হয়।
ঘোষণায় আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০২৪ সালের ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান’-এ।
বলা হয়, “আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে, আর আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে।”
ঘোষণাপত্রে দাবি করা হয়, জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং দেশ ত্যাগ করেন। একই দিনে অবৈধ দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে গঠিত।
এছাড়া ঘোষণায় সংবিধান সংস্কার, মানবাধিকার রক্ষা, সুশাসন, দুর্নীতি দমন এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪–কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার এই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করবে।
সবশেষে ঘোষণায় বলা হয়—“৫ আগস্ট ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।”