
দুই দফা প্রাইভেট কার পরিবর্তন করে পরিকল্পিতভাবে সীমান্তে পৌঁছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলায় জড়িত দুজন ভারতে পালিয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হামলাকারী দুজন ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সীমান্ত পার হতে কারা সহায়তা করেছে এবং পুরো নেটওয়ার্কে কারা যুক্ত ছিল, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তদন্তকারীরা। এ বিষয়ে গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
এদিকে সিংগাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শরিফ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে আশাবাদী খবর দিয়েছেন তার বড় ভাই ওমর ফারুক। তিনি বলেছেন, "নতুন করে শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি হয়নি।" একই সঙ্গে হাদিকে গুলি করার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল করিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মো. কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুজ্জামান এই আদেশ দেন।
তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সন্দেহভাজন হামলাকারী ফয়সাল ও আলমগীর ঘটনার পরদিন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ভুটিয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান। তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পরপরই তারা একটি প্রাইভেট কারে মিরপুর থেকে আশুলিয়া, পরে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহে প্রবেশ করে। সেখানে গিয়ে প্রথম গাড়িটি বদলে অন্য একটি প্রাইভেট কারে ওঠে তারা এবং উপজেলার ধারাবাজার পেট্রোল পাম্পে পৌঁছায়। সেখান থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলে করে তাদের ভুটিয়াপাড়া সীমান্তে নিয়ে যান। পরে সীমান্ত পার করে তাদের ভারতে পাঠানো হয় এবং ওপারে আরেক ব্যক্তি তাদের রিসিভ করে নেয়।
তবে মোটরসাইকেলচালকের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য সিবিরন দিও (৩৫) ও সঞ্জয় লিপি (২৫)-কে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দারা। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি হামলাকারীদের অবস্থান শনাক্তের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে পল্টন মডেল থানার বক্স কালভার্ট এলাকায় শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মিজানুর রহমান ভূঁঞা জানান, হামলাকারীরা সত্যিই ভারতে পালিয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে হালুয়াঘাট থানা পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করেছে।
হাদির শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে তার বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, "হাদির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হার্টবিট এখন স্বাভাবিক রয়েছে। আগের তুলনায় তার হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতাও বেড়েছে।" চিকিৎসকদের বরাতে তিনি জানান, বর্তমানে হাদির অবস্থা স্থিতিশীল।
সিংগাপুরে নেওয়ার সময় হাদির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হার্টবিট বেড়ে যাওয়ায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ফলে বিমানবন্দর থেকে তাকে দ্রুত সিংগাপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা স্যালাইনের মাধ্যমে একাধিক ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং প্রায় দুই ঘণ্টা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। এরপর তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেন।
গতকাল দুপুরে সিংগাপুরের চিকিৎসা পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জন ও হাদির চিকিৎসায় যুক্ত ডা. আব্দুল আহাদ গণমাধ্যমকে জানান, "সিংগাপুর জেনারেল হসপিটালের ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সে ভর্তির পর থেকেই নিউরোসার্জারি ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার টিম যৌথভাবে তার চিকিৎসা শুরু করে।" তিনি জানান, নেওয়ার পর করা ব্রেনের সিটি স্ক্যানে হাদির বাম পাশের ইস্কেমিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং ব্রেনে ফোলা বা ইডেমা এখনো রয়েছে। ব্রেন স্টেমে আঘাতের কারণে ভেন্টিকুলার সিস্টেমে চাপ তৈরি হওয়ায় চিকিৎসকদের জন্য পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং হয়ে আছে।
ডা. আহাদ আরও বলেন, "বর্তমানে হাদির কিডনি, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুস সচল আছে। তবে নিউরোলজিক্যাল রেসপন্স দৃশ্যমান কোনো উন্নতি বা অবনতি কোনোটিই লক্ষ করা যাচ্ছে না।" তিনি জানান, সর্বশেষ সিটি স্ক্যানে হাদির ফুসফুসে আগের মতোই রক্তের উপস্থিতি দেখা গেছে। এ কারণেই বাংলাদেশে থাকাকালে তার বুকে চেস্ট ড্রেন দেওয়া হয়েছিল এবং সিংগাপুরেও সেই জটিলতা বিবেচনায় রেখে শ্বাস-প্রশ্বাসের চিকিৎসা চলছে।
হাদিকে গুলি করার ঘটনায় ফয়সাল করিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মো. কবিরকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুজ্জামান গতকাল এই আদেশ দেন। র্যাব রবিবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলি এলাকার একটি ইটভাটার ছনের ঘর থেকে কবিরকে গ্রেফতার করে। সোমবার রাতে তাকে পল্টন থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং পরে মামলার তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।
রিমান্ড আবেদনে গোয়েন্দা পুলিশ উল্লেখ করে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা, নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং প্রার্থীদের মনোবল দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার পর কবির আত্মগোপনে চলে যান। তিনি এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মামলার রহস্য উদঘাটন ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়।
র্যাব জানিয়েছে, কবির রাজধানীর আদাবর থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি ওয়ার্ড শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি আদাবরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করেন এবং তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার সদর থানার বড় বিঘাই গ্রামে। ফয়সাল করিমের গ্রামের বাড়িও পটুয়াখালীতে।
এই ঘটনায় সোমবার ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু এবং বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এর আগের দিন হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। রিমান্ডে থাকা সব আসামিকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।