
বছরের পর বছর সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে চলেছেন পেশায় চিকিৎসক ইশরাত জাহান। তিনি কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন না। অ্যাসথেটিক হাব নামে তার নিজের একটি ত্বক পরিচর্যা ক্লিনিক আছে রাজধানীর বনানীতে। দৈনিক প্রায় লাখ টাকা আয়। কিন্তু বছরশেষে কর পরিশোধ করেন মাত্র ৫ হাজার টাকা। কর ফাঁকি দেয়ার কৌশল হিসেবে ডা. ইশরাত জাহান আয়কর রিটার্নে তার আয় ও সম্পদের সঠিক তথ্য দেন না।
এছাড়াও টিকটকার ডাক্তার ইশরাত জাহান চর্ম পরিচর্যার চিকিৎসা ফর্মুলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ও থ্রেডস-এ কনটেন্ট দিয়ে থাকেন নিয়মিত। উদ্দেশ্য, সম্ভাব্য মক্কেলকে ফাঁদে ফেলা। একবার কোনও মক্কেলকে তার অ্যাসথেটিক হাব-এ আনতে পারলেই ধাপে ধাপে নিতে থাকেন বড় অংকের অর্থ।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর অঞ্চল ৭ এর আওতায় সার্কেল ১৪২ (স্যালারি) কে দেয়া আয়কর রিটার্ন ফরম থেকে জানা যায়, ডা. ইশরাত জাহান তার বাৎসরিক আয় দেখিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ব্যাংকে নগদ জমার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা এবং অন্যান্য পরিসম্পদের মূল্য ৫৫ লাখ টাকা। ঋণ ও আর্থিক দায় দেখিয়েছেন ৩৬ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাংক এশিয়া বসুন্ধরা শাখায় ডা. ইশরাত জাহানের একটি হিসাবে ৩ কোটি টাকার এফডিআর ও অন্য একটি হিসাব থেকে সম্প্রতি দুই দফায় ৬০ লাখ ও ২০ লাখ করে অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে। জমি ক্রয়ের কাজে তিনি এই অর্থ পরিশোধ করেছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়াও ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকে পৃথক হিসাবে তার জমা রয়েছে কোটি টাকা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকে ৮ নম্বর সড়কের ২৪৮ নম্বর বাড়ির ২-বি ফ্ল্যাটটিও তার নিজের।
সরেজমিন পরিদর্শনে বনানীর কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ে অবস্থিত বহুতল কনকর্ড কলোজিয়ামের লেভেল ৯-এ গেলে দেখা যায় অ্যাসথেটিক হাব-এর অভ্যন্তরে চাকচিক্যময় আয়োজন। রয়েছে ডা. ইশরাতের ব্যক্তিগত চেম্বার, রোগী দেখার চেম্বার ও ৭টি পৃথক চিকিৎসা কক্ষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডা. ইশরাতের সৌন্দর্যচর্চার কন্টেন্ট দেখে এখানে প্রতিদিন আসেন অসংখ্য গ্রাহক বা চর্মরোগী।
সেবা নিতে আসা প্রত্যেককে ডাক্তার কনসালটেশন ফি হিসেবে দিতে হয় ১ হাজার টাকা এবং স্কিন অ্যানালাইসিস বাবদ আরও ৫০০ টাকা। এই হিসেবে দিনে ৫০ জন গ্রাহক পেলে অ্যাসথেটিক হাব-এর দৈনিক আয় হয় ৭৫ হাজার টাকা। গ্রাহকসংখ্যা দৈনিক ১০০ জন হলে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটি সেবা নিতে আসা গ্রাহকের প্রাথমিক ব্যয়। সমস্যা বড় হলে ব্যয় বাড়তে থাকে। বাড়ে ডা. ইশরাত জাহানের আয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অধ্যয়ন শেষ করে ডা. ইশরাত চর্মরোগের চিকিৎসা দিয়ে অল্প সময়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। এই কাজে তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে স্কয়ার ও ইউনিলিভারের মতো বিশ্বস্ত কোম্পানিগুলোর কসমেটিকস্ ও স্কিন কেয়ার পণ্যগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে কন্টেন্ট করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ব্যাপারে স্কয়ার এক পর্যায়ে তাকে আইনী নোটিশও দেয়। গত ২২ নভেম্বর তারিখে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মনজুরুল করিমের মাধ্যমে তিনি ওই আইনী নোটিশের জবাবে নিশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। জবাবে ভবিষ্যতে তিনি একই ধরনের আর কোনও কন্টেন্ট করবেন না এবং পূর্বে আপলোড করা কন্টেন্টগুলো অপসারণ করবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করেননি।
স্কয়ার টয়লেট্রিজের আইনজীবি আবু সালেহ মোহাম্মদ সানাউল্লাহ আইনী নোটিশে ডা. ইশরাতের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন ঢাকা ওয়াচকে বলেন, বিএমডিসি’র বিধি অনুযায়ী একজন মেডিকেল প্র্যাকটিশনার তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে অবশ্যই ‘এটিকেট ও এথিকস্’ মেনে চলবেন বলে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেটা না মেনে কেউ যদি কারো বাণিজ্যিক স্বার্থকে আঘাত করে তাহলে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যারা তুলনামূলক অদক্ষ এবং পেশায় সুনাম অর্জন করতে পারেনি তারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি তৎপর। এটা একটা সাম্প্রতিক প্রবণতা এবং বিএমডিসি এ নিয়ে একটি পৃথক আচরণবিধি প্রণয়নের উপর জোর দিচ্ছে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে ডা. ইশরাত জাহানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। গত শনিবার মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন নামে একজন ব্যক্তি নিজেকে ডা. ইশরাত জাহানের প্রতিষ্ঠান অ্যাসথেটিক হাব-এর পরিচালক দাবি করে ঢাকা ওয়াচের প্রতিবেদককে বলেন, “আসুন একদিন চা খাই। আলোচনা করি।”
দুদিন পর মঙ্গলবার ডা. ইশরাত তার ব্যক্তিগত সহকারী জান্নাতের মাধ্যমে কল দিয়ে বলেন, “আমার ট্যাক্স লইয়ার (যিনি তার কর ফাইল দেখাশুনা করেন) এর সঙ্গে কথা বলুন। আমি এসব জানিনা। উনি যেভাবে বলেন, আমি তাই করি।”