সুদেব চক্রবর্তী

মে দিবস নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবিতা


Literature/May Day.jpg

মে দিবস বা শ্রমিক দিবসের প্রভাব আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক। বিশেষকরে পুঁজিবাদের এই সময়ে চারিদিকে শ্রম শোষণ, শ্রমিকদের বঞ্চনা আর প্রতিনিয়ত শ্রমিক নিপীড়নের ঘটনাগুলো রোজই মে দিবসকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। প্রতিটি দেশে একেকটি হে মার্কেট সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে যারা মার্কসবাদী নন, কমিউনিজমকে এড়িয়ে যান তারাও অন্তত মে দিবসকে অস্বীকার করতে পারছেন না। দিবস কেন্দ্র করে বা মে দিবসের চেতনায় লেখা হয়েছে বহু কবিতা, উপন্যাস, গল্প ও গান। কলাকৈবল্যবাদী সাহিত্যিক বা শিল্পীরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী। এর বিপরীতে একদল মনে করেছেন শিল্প জীবনের জন্য। কিন্তু আজকের দিনে মীমাংসিত সত্য হলো শিল্প যেমন শিল্পের জন্য, তেমনি জীবনের জন্যও। ফলে শ্রমিকদের বঞ্চনা, পুঁজিবাদী সভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া মানুষের যাপন উঠে আসছে সাহিত্য ও শিল্পে। পিট সিগারের ‘টকিং ইউনিয়ন’ বা জোয়ান বায়েজের ‘জো হিল’ গান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

মে দিবস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বহু কবিতা লেখা হয়েছে। মে দিবস নিয়ে কবিতার কথা বললেই যে কবিতাটি সকলের মানসপটে ভেসে ওঠে সেটি হলো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা:

‘‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,/ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/ জীবনকে চায় ভালোবাসতে।”

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি- এই কবিতাটিকে শেখ লুৎফর রহমান সঙ্গীতে রূপদান করেছেন। মে দিবস নিয়ে প্রথম গানটি লিখেছিলেন ইজিন পাতিয়ের। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচ্য মে দিবস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম কবিতা ও তার কবিকে নিয়ে। তিরিশের দশকের আগে মে দিবস নিয়ে আমরা বাংলা কবিতা পাই না। রবীন্দ্রনাথ মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন বটে, কিন্তু মার্কসবাদকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু মার্কসবাদের ঐতিহাসিক সত্য ও শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্র উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি শ্রমিকদের নিয়ে লিখেছেন--‘সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মরে। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’ কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি মজুর’ কবিতাটা মে দিবসের কবিতা নয়, কিন্তু তাতে মে দিবসের চেতনা রয়েছে।

‘‘হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,/পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,/তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,/তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;/তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,/ তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!”

সুকান্ত ভট্টাচার্য এ ব্যাপারে আরও উজ্জ্বল। সুকান্ত নিজে মার্কসবাদী ছিলেন। মে দিবস নিয়ে তিনি লিখেছিলেন “১লা মে-র কবিতা '৪৬”। তিনি লিখেছিলেন- 

“লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে?”

এই যে বলছিলাম যারা কমিউনিস্ট নন, তারাও কীভাবে মে দিবসের চেতনা ধারণ করেছিলেন? কারণ ইউরোপের প্রগতি লেখক সংঘ যেমন অকমিউনিস্ট উদার মানবতাবাদী লেখক, যথা রোমাঁ রোলাঁদের মতো মানুষদের কাছে রাখার চেষ্টা করেছে, সমর্থন এবং সহযোগিতা লাভ করার চেষ্টা করেছে তেমনি ভারতের প্রগতি লেখক সংঘও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রেমচন্দ, সরোজিনী নাইডু, প্রমথ চৌধুরীরর মতো লেখকদের সাথেও সংযোগ স্থাপন করেছে।

যাহোক, তিরিশের দশকে যে পঞ্চপাণ্ডব- বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী এবং বিষ্ণু দে; এদের চারজনই ছিলেন কলাকৈবল্যবাদী। বিষ্ণু দে ছিলেন ব্যতিক্রম। হ্যা, বিষ্ণু দে-ই বাংলা সাহিত্যে প্রথম মে দিবস নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। তার 'সন্দীপের চর' কাব্যগ্রন্থে ‘মে দিন’ নামে আমরা এই কবিতাটি পাই--

‘মে দিনের গান অক্ষয় প্রাণে 
দুর্গত দেশে বঞ্চিত ত্রাণে
তোলে চৈতালী সুর 

ওরা ভাবে ঢাকে কাল বৈশাখী
মরণ ভিখারী শ্মশানের পাখি 
মশানে পোড়াবে মেঘ 

মে দিনের গানে আসন্নত্রাণে
হে লালকমল হে নীলকমল 
নাগপাশ ছেঁড়ো প্রাণ সন্ধানে 
স্বর্ণালঙ্কা চুর 

ওরা কি বাঁধাবে সমুদ্রশ্বাস 
বৈশাখী মেঘ ঝড়ের বাতাস 
রুষবে বজ্রবেগ?

মে দিনের গান কালবৈশাখী
ঝড়ে ডানা ঝাড়ে শ্মশানের পাখি 
মরণই মরণাতুর 

হাজার শকুন ওড়ে পথে ঘাটে 
মরিয়া ছলায় শত পাখসাটে 
ঢাকে নাকি ঝড়ো মেঘ?

হে পৃথিবী আজ এরা উন্মাদ 
তোমার সত্যে বৃথা সাধে বাদ
যুগান্তে ভঙ্গুর 

কুটিল ভেবেছে কেউটে কামড়ে 
কোটালে শকুনে পাখায় চাপড়ে 
রুধবে বজ্র বেগ!

হে পৃথিবী মাতা! বিশ্বজননী 
দৃঢ়পদে কড়া হাতে দিন গণি 
আশ্বাসে ভরপুর 

বিশ্বমাতার এ উজ্জীবনে
বৃষ্টিতে বাজে রুদ্রগগনে 
লক্ষ ঘোড়ার খুর 

বিশ্বমাতার কোটি সন্তান 
দেশে দেশে তোলে তুরঙ্গ গান 
অমোঘ নিরুদ্বেগ 

কোটি জলকণা এই জনতার
কালবৈশাখী রোখে বলো কার 
মেশিনগান বা চেক?

হে পৃথিবীমাতা নীল ধারাজলে
বিদ্যুতে বাজে পুড়ে খাক জ্বলে 
হে লালকমল হে নীলকমল 
পোড়া চোখ শত্রুর 

দুই হাতে ডাকে স্বাগত স্বাগত 
পথে ঘাটে মিলে গাঁয়ে গাঁয়ে শত 
উত্থান বন্ধুর 

মিলিত হাতের মে- দিনের মেঘ 
তাজিক  কাজাক রুশ উজবেক
হে লালকমল হে নীলকমল 
হাজার কসাক মেঘ।"

বিষ্ণু দে’র এই কবিতাই বাংলা সাহিত্যে মে দিবস নিয়ে প্রথম কবিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি জড়িয়ে পড়েন ফ্যাসিবাদ বিরোধী মুভমেন্টে। ফলে তার স্বদেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবাদ ফুটে ওঠে তার রচনায়। তার সৃষ্টি প্রতিফলিত হয় মার্কসবাদের দর্পনে। তিনি লিখেছেন- 


“কার পদধ্বনি আসে? কার?/ একি নয় যুগান্তর! নব অবতার।/ এ যে দস্যুদল! / হে ভদ্রা আমার!/ লুব্ধ যাযাবর! নির্ভীক আশ্বাসে আসে ঐশ্বর্য-লুণ্ঠনে,/ দ্বারকার অঙ্গনে অঙ্গনে/ চায় তারা রঙ্গিলাকে প্রিয়া ও জননী/ প্রাণৈশ্বর্যে ধনী,/ চায় তারা ফসলের ক্ষেত, দীঘি ও খামার/ চায় সোনা-জ্বালা খনি। চায় স্থিতি অবসর!... চোখে আজ কুরুক্ষেত্র, কানে তার মত্ত পদধ্বনি,/ ক্ষমা কোরো অতিক্রান্ত জীর্ণ অসুয়ারে।/ ব্যর্থ ধনঞ্জয় আজ, হে ভদ্রা আমার!/ হে সঞ্চয়, ব্যর্থ আজ গাণ্ডীব অক্ষয়॥

(পদধ্বনি/ পূর্বলেখ)


সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠি এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘পদধ্বনিতে বিষ্ণু দে অর্জুনের প্রতীকে আসন্ন বিপ্লবের সম্মুখীন বুর্জোয়ার ক্লৈব্যের ছবি এঁকেছেন। পদধ্বনি এখানে তাই শোষিত সমষ্টির সামাজিক বিপ্লবেরই পদধ্বনি।’ 
অর্থাৎ, বিষ্ণু দে’র কবিতায় আমরা যে মিথের ব্যবহার দেখতে পাই তাতেও মার্কসবাদের ছোঁয়া রয়েছে।

এভাবে বিষ্ণু দে ঢুকে পড়েন সাংগঠনিক কাঠামোতে। একসময়ে সংগঠন বনাম সাহিত্য- এরকম দ্বন্দ্বে ভোগেন। অবশ্য তিনি সাহিত্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। এক সময়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়দের সাথে তাত্ত্বিক তর্কেও লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তিনি মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ, তাই চেতনাবিচ্যুত হননি। পরবর্তীতে আমরা দেখি আরও অনেকে মে দিবস বা শ্রমিকদের শোষণমুক্তির জন্য কলম ধরেছেন। যেমন- দিনেশ দাস, মল্লিকা সেনগুপ্ত বা এখনও অনেকে লিখে চলেছেন। কিন্তু মে দিবসের প্রথম কবিতা রচয়িতা হিসেবে বিষ্ণু দে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

 

 

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×