
ইরানের রাজধানী তেহরান ভয়াবহ পানি সংকটের মুখে পড়েছে। শহরটির প্রধান পানির উৎস আমির কাবির বাঁধে এখন এমন পরিমাণ পানি আছে যা দিয়ে এক কোটি বাসিন্দার চাহিদা মাত্র ১৪ দিন মেটানো সম্ভব। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি খরায় রাজধানীর জলাধারগুলো দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে, যা সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পানি সংকটে রূপ নিতে পারে।
তেহরান পানি সরবরাহ কোম্পানির পরিচালক বেহজাদ পারসা জানান, আমির কাবির বাঁধে বর্তমানে মাত্র ১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি অবশিষ্ট আছে, যেখানে এক বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। তিনি সতর্ক করে বলেন, “বর্তমান স্তরে এটি মাত্র দুই সপ্তাহ তেহরানকে পানি সরবরাহ করতে পারবে।”
অক্টোবর মাসে স্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, গত শত বছরে এত কম বৃষ্টিপাত বিরল ঘটনা। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, আগামী মাসগুলোতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে রাজধানীতে পানির টেকসই ব্যবস্থাপনা বড় সংকটে পড়বে।
তেহরানের বাসিন্দারা ইতিমধ্যেই সংকটের প্রভাব টের পাচ্ছেন। এক নারী বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানকে বলেন, পানির চাপ কমে যাওয়ায় তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে পানি দ্রুত শেষ হয়ে যায় কিংবা একেবারেই পাওয়া যায় না। “বিদ্যুৎ চলে গেলে ইন্টারনেট আর লিফটও বন্ধ হয়ে যায়... এই পরিস্থিতি অসহনীয়, বিশেষ করে গরমের সময় যখন বায়ু দূষণ তীব্র থাকে,” বলেন ওই নারী, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমবর্ধমান পানি ঘাটতি এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। খুজেস্তান থেকে সিস্তান-বালুচিস্তান পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও একই চিত্র। পাঁচ বছর ধরে টানা শুষ্কতা এবং রেকর্ড তাপমাত্রার কারণে রাজধানীর পানির লাইন প্রায় শুকিয়ে আসছে। জলাধারগুলো ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে, আর নাগরিকদের সহনশীলতা ক্রমেই ক্ষয় হচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, যদি পানি ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য কাটছাঁট না আনা হয়, তবে রাজধানীর কিছু অংশ অচিরেই ‘ডে জিরো’ বা সম্পূর্ণ পানি-শূন্য অবস্থার মুখোমুখি হতে পারে। তখন ঘরে ঘরে পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে ট্যাংকার বা স্ট্যান্ডপাইপের মাধ্যমে সীমিত পানি বিতরণ করা হবে।
এই সতর্কতা বছরের শুরু থেকেই দেওয়া হচ্ছিল এবং গ্রীষ্মের তীব্র তাপের পর তা আরও জোরদার হয়েছে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক কাভেহ মাদানি বলেন, “এটি শুধু একটি পানি সংকট নয়, বরং পানির দেউলিয়াত্ব—এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে (পানি) এতটাই অতিরিক্তভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে ক্ষয়ক্ষতি আর পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।”
জাতিসংঘের মরুকরণ প্রতিরোধ কনভেনশনের ড্যানিয়েল সেগাই মন্তব্য করেন, ইরানের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে কীভাবে পানি সংকট, ভূমি অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা একত্রে একটি দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
যদি ‘ডে জিরো’ পরিস্থিতি আসে, তবে হাসপাতাল ও জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিয়ে সাধারণ বাড়িতে পানি সরবরাহ সীমিত করা হবে। বিভিন্ন এলাকায় পর্যায়ক্রমে পানি বন্ধ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। ধনী পরিবারগুলো হয়তো ছাদের ওপর সংরক্ষণ ট্যাংক বসাতে পারবে, কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য পরিস্থিতি হবে মারাত্মক কঠিন।
অধ্যাপক কাভেহ মাদানি বলেন, “মানুষ অত্যন্ত সহনশীল এবং দ্রুত অভিযোজিত হতে পারে। আমার বড় উদ্বেগ হলো... যদি পরবর্তী বছরটিও শুষ্ক যায়, তাহলে আগামী গ্রীষ্ম আরও কঠিন হবে।”
বিবিসি তেহরানের পানি সংকট মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলেও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, লন্ডন দূতাবাস এবং কনস্যুলেট কোনো জবাব দেয়নি।
তেহরান ইরানের বৃহত্তম শহর, যেখানে প্রায় এক কোটি মানুষ বাস করে। শহরটি পানির জন্য পাঁচটি প্রধান বাঁধের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে লার বাঁধ এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। পরিচালনাকারী সংস্থা জানিয়েছে, সেখানে এখন স্বাভাবিক স্তরের অতি সামান্য পানি অবশিষ্ট রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, পানির ব্যবহার অন্তত ২০ শতাংশ কমাতে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জুলাইয়ে পানির চাহিদা গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমেছে, কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সরবরাহ বজায় রাখতে আরও ১২ শতাংশ হ্রাস প্রয়োজন। এদিকে শক্তি সাশ্রয়ের উদ্যোগ হিসেবে সরকারি অফিসগুলো নিয়মিত বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক ক্ষতির অভিযোগ তুলেছেন।
তেহরানের এই সংকট শুধু একটি শহরের নয়, বরং ইরানের বৃহত্তর পানি ব্যবস্থাপনার এক গভীর সংকেত; যা আগামী মাসগুলোতে আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।