'বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যার্থ রাশেদ মাকসুদ কমিশন, পুঁজি হারিয়েছে ৫২ হাজার কোটি'
- ফরিদ শ্রাবণ
- প্রকাশঃ ০৯:৪৩ পিএম, ০৩ মে ২০২৫

৫ই আগষ্টের পরে নতুন বাংলাদেশে সব খাতে লেগেছে সংস্কার ও পরিবর্তনের ছোয়া। নতুন এ সংস্কারে দেশের অর্থনীতিতে যেখানে ঘুরে দাড়াচ্ছে সেখানে পুঁজিবাজার আরও ভঙ্গুর হচ্ছে। শিবলী রুবায়েতের পরে গত ১৮ আগষ্ট পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব গ্রহন করেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তার দায়িত্ব গ্রহনের সাড়ে আট মাসের থেকে অভিভাবকহীন পুঁজিবাজার ভালো দিন পার করেছিল। অভিভাবকহীন পুঁজিবাজার দেখেছে দুই হাজার কেটি টাকার উপরের লেনদেন। তবে রাশেদ মাকসুদের কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পরে সাড়ে আট মাসের বিনিয়েগকারী অর্ধলক্ষ কোটি টাকার বেশি পুঁজি হারিয়েছে। এরই সঙ্গে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স হারিয়েছে প্রায় হাজার পয়েন্ট। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পুরো মাসের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা যায় এপ্রিল মাসেই ১৭ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার রাশেদ মাকসুদের নেওয়া নানা পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফেরাতে ব্যার্থ হয়েছে। এরই প্রতিফলন বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে বারবার রাস্তায় নেমেছে বিনিয়েগকারীরা।
বিএসইসির চেয়ারম্যানের খন্দকার রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহনের পরে সূচক সামান্য বাড়লেও দিন দিন তা তলানিতে যাচ্ছে। তার গ্রহনের পূর্বে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৯০৩ থেকে ৯৮৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৩০ এপ্রিল সর্বশেষ কর্মদিবসে দাড়িয়েছে ৪৯১৭ পয়েন্টে, ডিএসইএস শরীয়া সূচক ১৭০ পয়েন্ট হাড়িয়ে ১০৯৪ পয়েন্ট এবং ৩৫৬ পয়েন্ট হাড়িয়ে ডিএসই-৩০ দাড়িয়েছে ১৮২২ পয়েন্টে। ধারাবাহিকভাবে পুঁজি হারাতে হারাতে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৫২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার বেশি। ডিএসইর লাগাতার পতনে লেনদেন নেমেছে তলানিতে। নামমাত্র লেনদেনে ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ব্যায় তুলতে পারছে না। এদিকে দৈনিক পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা কয়েকদিন পর পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। আর এসব কিছু সামাল দিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের উল্টো নিস্ব করতেছে।
একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বর্তমান কমিশন যে অদক্ষ তা বার বার প্রমান করছে। এ বাজারে দক্ষ অভিভাবকের প্রয়োজন। অভিভাবকহীন পুঁজিবাজারে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় তার সময় তিনশ কোটি টাকার নিচে লেনদেন নেমে আসে। তার কোন সংস্কার বাজারে আস্থা ফেরানো কেন্দ্রিক ছিল না।
৫০ লাখ বিনিয়োগকারী আনতে চান রাশেদ মাকসুদ সাড়ে আট মাসে পুঁজিবাজারে এনেছেন নামমাত্র বিনিয়োগকারী। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) এর তথ্য মতে সাড়ে আট মাসে পুঁজিবাজারে এসেছে ১৭ হাজার ৩৪৩ বিনিয়োগকারী। তবে আলোচ্য সমেয়ে পুঁজিবাজার হারিয়েছে ৬৯৪ বিদেশী বিনিয়োগকারী। প্রতিবেদনটি লেখার সময়ে সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল কর্মদিবস শেষে পুঁজিবাজারে রয়েছে ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৯৬ জন বিনিয়েগকারী।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল এক্সচেঞ্জ কমিশনের। ভালো মানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নিলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেকটাই ফিরতো। সামনে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব না দিলে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। রাশেদ মাকসুদ কমিশনে আস্থা না পাওয়ায় বাজার থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সামনে বাজারের আরও পতনের শঙ্কায় নতুন কোনো বিনিয়োগে যেতে চাইছে না অনেকেই। তারা এখন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারকে চাঙা করতে হলে নতুন ভালো মানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানো এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমরা কেউই ভালো নেই। ট্রেজারিতে সুদের হার বেড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। এতে করে পুঁজিবাজারে যাদের বিনিয়োগ করার কথা তারা আরও বাজার থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। সামনে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার। বড় যেসব কোম্পানি রয়েছে সেগুলো তালিকাভুক্ত করতে করহারের ব্যবধান বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি রেপো রেট কমানো দরকার। কারণ এর সঙ্গে সুদের হার জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কমিয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলো রয়েছে অনেক কড়াকড়ির মধ্যে, যা আগে ছিল না। বিনিয়োগকারীদেরও এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে। এর ফলাফল দেখা যাবে দীর্ঘ মেয়াদে।
এ বিষয়ে বিএসসি’র চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদে কে ফোন দিলেও তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুঁজিবাজার সংস্কারে যেসব উদ্যোগ
বিগত দিনে পুঁজিবাজারে হওয়া অনিয়ম আর দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে বিএসইসি বেশকিছু সংস্কার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে গত বছরের ৭ অক্টোবর পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পাশাপাশি পুঁজিবাজার ফোকাস গ্রুপও গঠন করে বিএসইসি। এরপর গত ২০ অক্টোবর একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। পুঁজিবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্যই গঠন করা হয় এ কমিটি। এ ছাড়া বাজারের উন্নয়নে নেওয়া হয় একগুচ্ছ নীতি পদক্ষেপের উদ্যোগ। কিন্তু এতসব উদ্যোগের কোনোটিই যেন দিনশেষে কাজে আসছে না।
শেয়ারবাজারে একজন বিনিয়োগকারী মেসবাহ উদ্দিন টিপু ঢাকাওয়াচটুয়েন্টিফোরকে বলেন, ৫ই আগস্ট আমার ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল সেটা এখন নেমে আড়াই লাখ টাকায় আসছে। তিনি বলেন রাশেদ মাকসুদ কমিশন হলো গত ২০ বছরে সবচেয়ে খারাপ কমিশন। পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন নিঃস্ব। এই মুহুর্তে শেয়ারবজারে কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করার মত সাহস নাই।
এছাড়া বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ও আইসিবি'র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ এর পদত্যাগগের দাবিতে গত সপ্তাহে মতিঝিল মানববন্ধন করেন বিনিয়োগকারীরা।