
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি মো: হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ কেলেঙ্কারি, নাম নকল জালিয়াতি এবং বিতর্কিত পুনঃনিয়োগ ও এস আলম গ্রুপ, রংধনু বিল্ডার্সসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত আছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্ট, দুদকের চার্জশিট এবং ব্যাংক বোর্ডের সিদ্ধান্ত থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার বিরুদ্ধে আনীত একাধিক সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ঘটনাগুলোর মধ্যে:
রংধনু বিল্ডার্সকে ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডারের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান:
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান এর পুর্ব কর্মস্থল ইউনিয়ন ব্যাংকে থাকাকালীন বিভিন্ন অনিয়ম, দূর্ণীতি ও অর্থ আত্মসাতের খবরও উন্মোচিত হচ্ছে।
তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকে থাকাকালীন রূপগঞ্জের বিতর্কিত ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম (ওরফে আন্ডা রফিক) এর প্রতিষ্ঠান রংধনু বিল্ডার্স লিমিটেডকে পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি–২ এর ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, ২০২৩ সাল থেকেই এই ঋণ অনাদায়ী ও খেলাপি অবস্থায় আছে।
উল্লেখিত, আলোচিত এই ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে বর্তমানে দুদক কাজ করছে এবং তদন্তের জন্য হাবিবুরকে দুদকে বিভিন্ন সময়ে তলব করা এবং ইউনিয়ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন ঋণ প্রদানের স্বপক্ষে সকল কাগজপত্র ও প্রমানাদী জমাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের ২৬০৭ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি ও হাবিবুরের সংশ্লিষ্টতা:
বিশ্বস্ত সূত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ-৭ (DBI-7) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউনিয়ন ব্যাংকে কর্মরত থাকাকালে মো. হাবিবুর রহমান এস আলম গ্রুপের অনুকূলে ২৬০৭ কোটি টাকার অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। ২০২১–২২ সালে প্রায় ৩০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ কোটি থেকে ১৪৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়, যার অধিকাংশই বর্তমানে সম্পূর্ণ খেলাপি এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। হাবিবুর রহমান এসব ঋণের প্রস্তাব ও অফিস নোটে স্বাক্ষর করেন, যা “প্রধান কার্যালয়ের প্রথম ও শেষ অনুমোদন” হিসেবে বিবেচিত।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক মামলা ও দুদকের চার্জশিট:
মার্কেন্টাইল ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকালে “প্যাট্রিক ফ্যাশনস” নামের একটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ গোপন করে নতুন করে ৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলাটি বর্তমানে মেট্রো স্পেশাল কোর্টে (মামলা নং ২৭২/২২) বিচারাধীন এবং তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি। এই মামলায় তিনি বর্তমানে আগাম জামিনে রয়েছেন।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে ৬০ দিনের মধ্যে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলে হাবিবুর রহমান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদনও দেয়। কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে পুনরায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিতর্কিত পুনঃনিয়োগ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে তিনি পদত্যাগ করার কয়েক মাসের মধ্যেই আগস্ট ২০২৪ এ পুনরায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন পায়। ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, চার্জশিটভুক্ত ও অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির এমন পুনঃনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে বাধ্যতামূলক ছুটি:
হাবিবুরের বিভিন্ন অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের সাথে সংশ্লিষ্টতা, দূর্ণীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে গত ৩০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত ১১ জন পরিচালকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে মো. হাবিবুর রহমানকে ৯০ দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছয়জন পরিচালকের স্বাক্ষরিত বোর্ডের কার্যনির্বাহী বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয় এবং পরবর্তীতে সশরীরে বিআরপিডিতে জমা দিয়ে গভর্নরকে মৌখিকভাবেও অবহিত করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, হাবিবুরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ পূনরায় খতিয়ে দেখতে গভর্নরের নির্দেশে তাৎক্ষনিক ইউনিয়ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শক দলকে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরবতা ও অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের অভিযোগ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সূত্র মতে, FICSD কর্তৃক পরিচালিত পরিদর্শন পরবর্তী রিপোর্ট বর্তমানে BRPD তে আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই রিপোর্ট ফাইলবন্দী হয়ে কোন অজ্ঞাত কারণে BRPD তে থেমে আছে।
উল্লেখ্য, বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পর হাবিবুরের বিরুদ্ধে পরিদর্শন চলমান অবস্থায় গত ৬ অক্টোবর ২০২৫ ইং BRPD পরিচালক মো: আলাউদ্দিন সাক্ষরিত এক পরিপত্রে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের দৈন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য হাবিবুর রহমানকে সাময়িক নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান করা হয়।
অভিযোগ পরবর্তী পরিদর্শনের রিপোর্টের খুঁটিনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক বার ফোন করেও হাবিবুর রহমানের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মত:
অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, “একজন চার্জশিটভুক্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট তৈরি করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
হাবিবুর রহমান কে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটের রিপোর্ট দিতে বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকাওয়াচকে বলেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এর অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে এবং অবিলম্বে রিপোর্ট প্রকাশ করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।