
রাজধানীর রামপুরায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টাসহ দুজনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আজ পঞ্চম দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এই মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন সাক্ষীরা।
সোমবার (১০ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আজ দুইজন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেবেন বলে জানা গেছে।
এর আগে ৪ নভেম্বর দুজন সাক্ষী; পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. গোলাম কিবরিয়া খান ও তদন্ত সংস্থার সহকারী লাইব্রেরিয়ান কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিক জবানবন্দি প্রদান করেন। তাদের সাক্ষ্য শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন এবং গ্রেপ্তার আসামি চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে আইনজীবী সারওয়ার জাহান জেরা সম্পন্ন করেন। এখন পর্যন্ত মোট ছয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন গাজী এমএইচ তামিম। তার সঙ্গে রয়েছেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, সাইমুম রেজা তালুকদার ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
এর আগে ৩ নভেম্বর তৃতীয় ও চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন শহীদ মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা এবং প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইয়াকুব। তারা ট্রাইব্যুনালের সামনে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নৃশংসতা ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন এবং ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবি জানান।
দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে ২৭ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন গুলিবিদ্ধ বাসিত খান মুসার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ওইদিনের ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানান, তার চোখের সামনে ছেলেকে গুলি করা হয়, একই বুলেটে প্রাণ হারান মুসার মা মায়া ইসলাম। গুলিবিদ্ধ শিশুটি এখনো কথা বলতে পারে না।
২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের উদ্বোধনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন গুলিবিদ্ধ ভুক্তভোগী আমির হোসেন।
ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয়। ওইদিন গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে আইনজীবী সারওয়ার জাহান অভিযোগ পড়ে শোনান, এবং চঞ্চল নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
মামলায় গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি হলেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। অন্য আসামিরা হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান এবং সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। তাদের বিরুদ্ধে গত ১০ আগস্ট গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল গত ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেয়। এর আগে ২৫ আগস্ট তাদের হাজিরের নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৭ আগস্ট প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন এবং ৩১ জুলাই তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
মামলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেলে আমির হোসেন কাজ শেষে ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন। রামপুরার বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কে পুলিশ ও বিজিবির উপস্থিতি দেখে তিনি ভয়ে পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে ওঠেন। সেখানে পুলিশ ধাওয়া দিলে তিনি ছাদের কার্নিশে রড ধরে ঝুলে পড়েন। এরপর এক পুলিশ সদস্য তার দিকে ছয়টি গুলি ছোড়ে, ফলে তিনি নিচে পড়ে যান। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বনশ্রীর একটি হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।
ওইদিন একই এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন নাদিম ও মায়া ইসলাম। গুলিবিদ্ধ হয় মায়া ইসলামের ছয় বছরের নাতি বাসিত খান মুসা, যিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েও এখনো কথা বলতে পারেন না।
এ বছরের ২৬ জানুয়ারি রাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।