
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আবারও সামনে এসেছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় গেজেটে আজও স্থান পায়নি ফেনীর সন্তান, শহীদ কবি ও সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নাম।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন জাতি বিজয়ের অপেক্ষায়, ঠিক সেই সময় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। সেই হত্যাযজ্ঞের শিকার হন সেলিনা পারভীনও।
সরকার ইতোমধ্যে দুই দফায় গেজেট প্রকাশ করে মোট ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। এই তালিকায় ফেনীর ১০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম থাকলেও সেলিনা পারভীনের নাম এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রথম দফায় গেজেটভুক্ত ১৯১ জনের মধ্যে ফেনীর আটজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তারা হলেন জহির রায়হান, ড. আ.ন.ম ফজলুল হক মহী, ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী, প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ার, ডা. মেজর রেজাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. সিদ্দিক আহমেদ এবং ড. সিরাজুল হক খান।
দ্বিতীয় দফায় আরও তিনজন ফেনীর শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম যুক্ত হয়। তারা হলেন ড. রফিক আহমেদ, প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ার এবং প্রকৌশলী সেকান্দর হায়াত চৌধুরী। তবে প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ারের নাম দুই দফাতেই থাকলেও শহীদ সেলিনা পারভীনের স্বীকৃতি মিলেনি।
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ সেলিনা পারভীনকে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘সেদিন শহরে কারফিউ চলছিল। রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সুমনদের (সেলিনা পারভীনের ছেলে) বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল আলবদররা। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। সেলিনা পারভীনের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা। তিনি নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এই সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর কথা হয়। এরপর তারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীর লাশ রায়ের বাজার বধ্যভূমির ডোবায় পাওয়া গিয়েছিল। আর কিছু মিরপুর বধ্যভূমিতে। সেলিনা পারভীনের গলিত লাশও ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল। অত্যাচারে বীভৎস হওয়া আর ডোবায় পচা জলে গলে যাওয়া লাশ চিহ্নিত করা খুব কঠিন ছিল তখন। তার পায়ের সাদা মোজা দেখে, তাকে চিনতে পেরেছিল পরিবারের স্বজনরা। অত্যন্ত শীত কাতুরে সেলিনা পারভীন ডিসেম্বরের সেই ক’টা দিন প্রচণ্ড শীতে, রায়ের বাজারের ডোবায় পড়ে ছিলেন, নিথর, লাশ হয়ে।’
‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সাংবাদিকতা পদক ২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও অধ্যক্ষ মাহফুজা খানম বলেন, ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া একমাত্র নারী ছিলেন সেলিনা পারভীন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে কোনোভাবে স্বীকৃতির কথা নেই, তার নাম উচ্চারিত হয় কিনা আমার জানা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, তাকে আগামী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা। কিন্তু সরকারিভাবে সেটি করা হয়নি।’
সেলিনা পারভীনের অপহরণের বর্ণনা দিয়েছেন বিশিষ্ট নারী অধিকারকর্মী মালেকা বেগম। স্মৃতিচারণায় তিনি লেখেন, ‘১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় কয়েকজন এসে বলল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সের ছিল। সব স্মরণ আছে তার। বলেছে, তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মোড়ায় বসে রান্না করছিলেন। বললেন, পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিলো না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঘাতকদের সাথে যাওয়ার সময় ছেলে সুমনকে বলে গিয়েছিলেন কাজ শেষ করে দ্রুতই ফিরবেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। মিরপুরের বধ্যভূমিতে পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা, বেয়োনেটে ক্ষত-বিক্ষত, অর্ধগলিত অনেক মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যেগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি শিক্ষক, ডাক্তার, চিকিৎসক, অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিতজনের। হতভাগ্য এই গুণীজনদের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে খুব সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা জুতা আর মোজা থাকায় খুব সহজেই চেনা গিয়েছিল এটা সুমনের মা, সেলিনা পারভীন।’
স্বাধীনতার পর জাতীয় প্রেসক্লাবের শহীদ সাংবাদিকদের নামফলকে সেলিনা পারভীনের নাম খোদাই করা হয়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরিজে তার নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে তার জীবনের তথ্য সংযোজিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ, যেমন “শত শহীদ বুদ্ধিজীবী গ্রন্থ”, “শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ” ও “স্মৃতি-৭১” গ্রন্থেও তার ওপর আলোচনা রয়েছে। এছাড়া দেশি-বিদেশি বই, প্রামাণ্যচিত্র, জাতীয় জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। সাংস্কৃতিক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও তাকে শহীদ হিসেবে বিশেষ স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হয়েছে। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র “শিলালিপি”, যা তাকে উৎসর্গ করা হয়। ঢাকার মৌচাক থেকে মগবাজার পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক।
১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন সেলিনা পারভীন। তার বাবা আবিদুর রহমান ছিলেন একজন শিক্ষক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরিবারসহ ঢাকায় অবস্থান করেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।
প্রতিবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ফেনীতেও নানা কর্মসূচির আয়োজন হলেও দিবস শেষ হলে স্মৃতি ফিকে হয়ে যায় বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। তাদের মতে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্থায়ী উদ্যোগ ও সংরক্ষণের অভাব প্রকট।
এ বিষয়ে সমাজকর্মী আসাদুজ্জামান দারা বলেন, বুদ্ধিজীবীদের যথাযথ সম্মান দেখাতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। তার ভাষায়, বুদ্ধিজীবীদের বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও তা পালন করা হয়নি। ফেনীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে স্থায়ী কোনো স্মারক নেই। তার মতে, শহীদ সেলিনা পারভীনের গেজেটে নাম না থাকা সরকারের উদাসীনতারই প্রতিফলন।