
বঙ্গোপসাগরের প্রবালঘেরা দ্বীপ সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের জন্য ১ নভেম্বর থেকে উন্মুক্ত করা হলেও আট দিন পেরিয়ে আজ শনিবার পর্যন্ত সেখানে একজন পর্যটকেরও পদচারণা হয়নি। দ্বীপে যাওয়ার জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় ভ্রমণকারীরা যেতে পারছেন না, ফলে ২৩০টিরও বেশি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ এবং শতাধিক রেস্তোরাঁ খালি পড়ে আছে।
সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, কক্সবাজার থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবেন। তবে নভেম্বর মাসে রাতযাপনের অনুমতি থাকবে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পর্যটকদের রাত কাটানোর সুযোগ দেওয়া হবে।
কিন্তু জাহাজমালিকদের দাবি, কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপে গিয়ে একই দিনে ফিরে আসা কষ্টসাধ্য। তাই পর্যটকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন, যার ফলে পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় জাহাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো নৌযান সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবে না। ভ্রমণকারীদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কিনতে হবে, যেখানে প্রতিটি টিকিটে থাকবে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড। কিউআর কোডবিহীন টিকিট অবৈধ বলে গণ্য হবে।
সরকারের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে সেন্ট মার্টিনের জীব ও পরিবেশ রক্ষার বেপার উল্লেখ করে বলা হয়, রাতের বেলা সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ করা, বারবিকিউ আয়োজন, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা বিক্রি, কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজ কাঁকড়া বা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সৈকতে মোটরচালিত যান চলাচল, পলিথিন বহন এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের (যেমন পানির বোতল, স্ট্র, চিপসের প্যাকেট, ছোট সাবান বা শ্যাম্পু) ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, “নভেম্বর মাসে রাতযাপনের সুযোগ না থাকায় পর্যটকেরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। টিকিট বিক্রি না হলে জাহাজ চালানোও সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনে একদিনে আসা-যাওয়া করতে একটি জাহাজের জ্বালানি ও কর্মচারীর খরচসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা লাগে। পর্যটক না থাকলে এ খরচ পুরোপুরি লোকসান। তাই নভেম্বর মাসে আপাতত জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।”
হোসাইন ইসলাম জানান, ১ নভেম্বর থেকে এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ও বার আউলিয়া নামের দুটি জাহাজকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং আরও চারটি জাহাজ চলাচলের অপেক্ষায় আছে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার পর্যটক পরিবহন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার (০৭ নভেম্বর) থেকে কক্সবাজার সৈকতে ভিড় বেড়েছে। হোটেল মালিক সমিতির তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে প্রায় দেড় লাখ পর্যটক সৈকত ভ্রমণে এসেছেন। তবে অনেকেই সেন্ট মার্টিন যেতে চাইলেও রাতযাপনের নিষেধাজ্ঞার কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
তবে শনিবার (০৮ নভেম্বর) সকালে কক্সবাজারের নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ জেটি ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সেন্ট মার্টিনগামী কোনো পর্যটক বা জাহাজ নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা বলেন, “পর্যটক নেই, তাই জাহাজও চলছে না। ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য সেন্ট মার্টিন খোলা হলেও আট দিনে কেউই যেতে পারেননি।”
এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত টানা নয় মাস কক্সবাজার–সেন্ট মার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। সরকারের নির্দেশনায় কক্সবাজার ঘাট ছাড়া উখিয়ার ইনানী বা টেকনাফ থেকে কোনো জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ। দ্বীপে পর্যটক না থাকায় হতাশ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সেন্ট মার্টিন হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি শিবলুল আযম কোরেশী বলেন, “১ নভেম্বর থেকে পর্যটক বরণের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কোটি টাকা ব্যয়ে হোটেল-রিসোর্ট সংস্কার করা হয়। কিন্তু রাতযাপনের অনুমতি না থাকায় কেউ আসছে না।”
তিনি আরও বলেন, “ডিসেম্বর-জানুয়ারির মতো নভেম্বর মাসেও যদি রাত কাটানোর সুযোগ থাকত, তাহলে এ সংকট হতো না। এখন পরিবেশ রক্ষার নামে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মুখে ফেলা হচ্ছে, দ্বীপের মানুষের জীবিকাও ঝুঁকিতে পড়েছে।”
সেন্ট মার্টিন দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি মৌলভি নুর মোহাম্মদ জানান, তিন বছর আগেও টেকনাফ থেকে প্রতিদিন ৯ থেকে ১১টি জাহাজে পাঁচ–ছয় হাজার পর্যটক দ্বীপে যাতায়াত করতেন। এখন সেই চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো—দ্বীপ জুড়ে নীরবতা আর খালি হোটেল।