
ভুল স্বপ্নের নেশায় বিদেশ যাওয়ার পথে বিপুল অর্থ ও নিরাপত্তা হারিয়েছেন সুনামগঞ্জের ২৬৫ জন তরুণ। গত দুই বছরে তারা অবৈধভাবে ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু লিবিয়ার কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। অধিকাংশেই কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে, কেউ ঋণ নিয়ে দালালদের হাতে ১৮ থেকে ২৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। স্বপ্নের ইউরোপের বদলে তারা ফিরে এসেছেন নিঃস্ব, নির্যাতিত এবং মানসিক ক্ষত নিয়ে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে শাকিল আহমদ তার এই যাত্রার বর্ণনা দেন। শাকিল বলেন, "ভালো কাজের আশায় ইতালি যাওয়ার লোভে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়েছিলাম। ২০২৩ সালের মে মাসে দালালের মাধ্যমে কয়েকটি দেশ পেরিয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর চুক্তি করি। প্রাথমিকভাবে সাড়ে চার লাখ টাকায় চুক্তি হয়। টাকা পরিশোধের পর প্রথমে দুবাই যাই। সেখানে এক মাস থেকে অবৈধভাবে মিসরে প্রবেশ করি এবং পরদিন লিবিয়ায় পৌঁছাই।"
শাকিল আরও জানান, লিবিয়ায় পৌঁছে শরীয়তপুরের এক দালালের সঙ্গে নতুন করে সাড়ে ৬ লাখ টাকায় চুক্তি করেন, যার প্রতিশ্রুতি ছিল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছে দেওয়া। পরিশোধের পর ৪৮ জনের একটি দলের সঙ্গে তাকে অপেক্ষায় রাখা হয়, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দালাল তাদের লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেন। পরে এক অংশ দালালচক্র ফের তাদের কয়েকজনকে কিনে নেয়, যার পর শুরু হয় মুক্তিপণের জন্য নৃশংস নির্যাতন। শাকিল বলেন, "তাহলে আমরা স্বাভাবিকভাবে দালালদের মুক্তিপণ দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই।"
শাকিলের মতোই ভাটি সাফেলা গ্রামের জাকারিয়া আহমেদ ইয়াহিয়া বলছেন, "দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার জন্য দুবাই, মিসরসহ আরও একটি দেশ হয়ে লিবিয়া যেতে আমাকে দিতে হয়েছিল চার লাখ টাকা। লিবিয়ায় পৌঁছে আরও চার লাখ টাকায় চুক্তি করি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য।" তিনি জানান, দালালরা ভূমধ্যসাগরের যাত্রাকে ‘গেম’ বলে উপস্থাপন করত। ৮ থেকে ৯ মাস অপেক্ষার পর ১২০ জনকে একটি নৌকায় তোলা হয়, কিন্তু সাগরের মাঝপথে লিবিয়ার কোস্টগার্ড তাদের আটক করে। পাঁচ দিন কারাভোগের পর কুমিল্লার মাফিয়া রাসেল তাঁকে এবং আরও এক বাংলাদেশিকে কিনে নেয়। "আমাদেরকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। যারা দিতে পারেনি, তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো," তিনি জানান।
জাকারিয়া যোগ করেন, "দুই দিনের মধ্যে বাড়ি থেকে ৬ লাখ টাকা আনতে বলা হয়েছিল। আমি জমি বিক্রি করে টাকা পাঠাই। পরিবার সময়মতো পাঠানোর কারণে আমাকে ছেড়ে দেয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরেছি। এখনও ধারদেনা শোধ করতে পারিনি।"
ব্র্যাক মাইগ্রেশনের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, অনিরাপদভাবে ইউরোপে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিরিয়া। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ বৈধভাবে বিদেশ গেছেন, যা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১১৫ জনের সমান। এদের বড় অংশই অদক্ষ।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সমর কুমার পাল বলেন, "জেলা প্রশাসনের প্রবাসী কল্যাণ সেল আছে। দূতাবাসের নির্দেশনা পেলে প্রবাসী কল্যাণ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তারা কাজ করে। তবে অবৈধভাবে যারা প্রবাসে যান, তাদের বিষয়ে এই সেল কোনো কাজ করছে না।"
ব্র্যাকের এমআরএসসি কোঅর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম জানান, "দালালের ফাঁদে পড়ে অনেকে বিদেশ পাড়ি দেন। সুনামগঞ্জে ২৬৫ জন তরুণ দালালের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে লিবিয়া থেকে ফেরত এসেছেন। যারা ফেরত এসেছেন, তাদের তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। অনেকেই লিবিয়া থেকে গেমে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যান। তাদের তথ্য আমাদের কাছে নেই। তরুণরা যেন অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি না জমান, সেজন্য আমরা সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি।"