
সিরিয়ার নবগঠিত সরকারকে অস্থিতিশীল করতে বাশার আল-আসাদের নির্বাসিত অনুগতরা গোপনে সংগঠিত হচ্ছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। আটকানো ফোনকল ও বার্তার সূত্রে জানা গেছে, সাবেক শাসনামলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সশস্ত্র নেটওয়ার্ক পুনর্গঠন এবং বিদেশে লবিং তৎপরতায় যুক্ত।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (এনওয়াইটি) জানিয়েছে, আসাদের ঘনিষ্ঠ নির্বাসিত কয়েকজন ব্যক্তি “তাদের উৎখাতকারী নবনির্মিত সরকারকে দুর্বল করার” পাশাপাশি সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া ও লেবাননে অবস্থানরত সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ও সামরিক কমান্ডাররা নীরবে আসাদের শাসনের সাম্প্রদায়িক ভিত্তি আলাউই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুগতদের নেটওয়ার্ক আবার সক্রিয় করছেন।

এনওয়াইটির তথ্যমতে, এই উদ্যোগের কেন্দ্রে রয়েছেন সাবেক বিশেষ বাহিনীর কমান্ডার সুহাইল আল-হাসান—যিনি “দ্য টাইগার” নামে পরিচিত—এবং সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান মেজর-জেনারেল কামাল হাসান। দুজনই আসাদের সঙ্গে মস্কোতে নির্বাসনে গেলেও, আটকানো যোগাযোগে দেখা যায় তারা সিরিয়ার ভেতরে প্রভাব পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যালোচিত টেক্সট বার্তায় দেখা গেছে, আল-হাসান “গত এক বছরে লেবানন, ইরাক এমনকি সিরিয়ার অভ্যন্তরে সহযোগীদের সাথে দেখা করেছেন”। কিছু বার্তায় উপকূলীয় গ্রামগুলোতে যোদ্ধা ও অস্ত্রের তালিকাসহ হাতে লেখা চার্ট ছিল, যেখানে দাবি করা হয়েছিল—কয়েক হাজার যোদ্ধা একত্র করা সম্ভব। একাধিক বার্তায় তিনি নিজেকে “পবিত্র যোদ্ধা” হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন।

পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত তিনজন ব্যক্তি এনওয়াইটিকে জানান, আল-হাসান আসাদের কোটিপতি চাচাতো ভাই রামি মাখলুফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন। মস্কোতে অবস্থানরত মাখলুফ উপকূলীয় দরিদ্র আলাউই পরিবারগুলোর মধ্যে অর্থ পাঠিয়ে এবং নিজেকে সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরে এই প্রচেষ্টায় অর্থায়নে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে ভেঙে দেওয়া চতুর্থ ডিভিশনের সাবেক কমান্ডার গিয়াস ডাল্লা এই ষড়যন্ত্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন এবং লেবানন থেকে সমন্বয় করছিলেন। ২০২৫ সালের এপ্রিলে আটকানো এক ফোনকলে ডাল্লাকে বলতে শোনা যায়, “সম্পূর্ণ সশস্ত্র না হওয়া পর্যন্ত আমরা শুরু করব না।”

বার্তাগুলোতে দেখা যায়, ডাল্লা সম্ভাব্য যোদ্ধা ও স্থানীয় কমান্ডারদের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ ডলার বিতরণ করছিলেন, যেখানে ব্যক্তিপ্রতি ২০০ থেকে ১,০০০ ডলার পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছিল। তিনি ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বেশি মূল্যের স্যাটেলাইট যোগাযোগ সরঞ্জাম কেনার অনুমোদনও চেয়েছিলেন।
অন্য বার্তালাপে ইরান-সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া নেতাদের সঙ্গে সিরিয়ায় অস্ত্র পাচার নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে—যাতে ইসরায়েলি বিমান হামলা বা সিরিয়ান কর্তৃপক্ষের নজরদারি এড়ানো যায়। এসব যোগাযোগে হত্যার পরিকল্পনা বাতিল, ড্রোন ও ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা এবং সিরিয়ার ভেতরে লুকানো অস্ত্রের কথাও উঠে এসেছে।
এপ্রিলে সিরিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক ঢেউয়ে ১,৬০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পরপরই আটকানো এসব বার্তা প্রকাশ্যে আসে। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন আলাউই। নতুন সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত হামলার পর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা যোদ্ধা সমাবেশের ক্ষেত্র হিসেবে সাবেক শাসকগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

কিছু সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এনওয়াইটিকে বলেছেন, ভয় ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আলাউইদের মধ্যে নিয়োগ সম্ভব হতে পারে। তবে অন্যরা সতর্ক করেছেন—দীর্ঘ যুদ্ধের পরও আসাদের শাসনের প্রতি ক্ষোভ তীব্র রয়ে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান এমন একটি ফাউন্ডেশনকে সমর্থন দিচ্ছিলেন, যারা ওয়াশিংটনে লবিংয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। সহযোগীরা তাকে বৈরুতভিত্তিক ‘ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ ওয়েস্টার্ন সিরিয়া’র সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা নিজেকে সিরিয়ার সংখ্যালঘু ও বাস্তুচ্যুত আলাউইদের পক্ষে কাজ করা সংগঠন হিসেবে তুলে ধরে।

মার্কিন প্রকাশ্য নথি অনুযায়ী, ফাউন্ডেশনটি লবিং ফার্ম টাইগার হিল পার্টনার্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা জোসেফ স্মিটজকে ১০ লাখ ডলারের চুক্তিতে নিয়োগ দেয়। সংগঠনটি কয়েকজন মার্কিন আইনপ্রণেতার দপ্তরের সঙ্গে বৈঠকের কথাও প্রচার করেছে, যদিও সহযোগীরা বলেছেন—এসব ছিল নিয়মিত ও কর্মীপর্যায়ের বৈঠক।
হাসানের সঙ্গে কাজ করা ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি তাৎক্ষণিক বিদ্রোহের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রভাব তৈরিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন। এর মধ্যে আলাউই-অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য “আন্তর্জাতিক সুরক্ষা” দাবি প্রচারের উদ্যোগও ছিল।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সাবেক শাসকগোষ্ঠীর ওপর নজরদারিতে থাকা কর্মকর্তারা সমন্বিত সশস্ত্র বিদ্রোহের আশঙ্কাকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিলেও বিদেশে লবিং তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কূটনীতিকদের আশঙ্কা, সিরিয়ার রাজনৈতিক রূপান্তর ব্যর্থ হলে দেশটি ধীরে ধীরে বিভক্ত বা আধা-স্বায়ত্তশাসনের পথে যেতে পারে।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করে বিভাজনকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ইসরায়েল সিরিয়াজুড়ে বিমান হামলা জোরদার করেছে, সামরিক স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো লক্ষ্য করে আঘাত হেনেছে এবং দক্ষিণ সিরিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজের ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব পদক্ষেপ দেশকে অস্থিতিশীল করার সাবেক শাসনঘনিষ্ঠদের তৎপরতাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
সূত্র: middle east eye