নরসিংদীর মাধবদীতে সৃষ্ট ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প মুহূর্তেই কাঁপিয়ে তোলে রাজধানীসহ পুরো দেশকে। এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের মৃত্যু এবং পাঁচ শতাধিক মানুষের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দেশি-বিদেশি সিসমোলজিক্যাল সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ১০ কিলোমিটার নিচে শক্তির দীর্ঘদিনের সঞ্চয় থেকেই এই ভূমিকম্পের জন্ম।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, প্রায় সাত কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় এই কম্পন অনুভব করেছেন। আবহাওয়া বিভাগ এই ভূমিকম্পকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছে।
শনিবার (২২ নভেম্বর) একই এলাকায় আরও দুই দফা ভূমিকম্প হয়- যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩ ও ৪ দশমিক ৩ মাত্রার। দুটিরই কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর পলাশে।
এখন প্রশ্ন উঠছে- সাধারণত বড় ভূমিকম্পের উৎস হিসেবে পরিচিত নয় এমন নরসিংদী কেন হঠাৎ এমন শক্তিশালী কম্পনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল?
‘প্লেট লক’ খুলে গেছে, বড় কম্পনের পূর্বাভাস’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, নরসিংদীর এই ভূমিকম্প মূলত ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থানগত পরিবর্তনের ফল।
তার ভাষায়, “প্লেটগুলো ধাক্কা দেয়, সরে যায়, ফাটল তৈরি করে, এতে শক্তি জমে। সেই শক্তি শিলার ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেলে ফাটল ধরে ভূমিকম্প হয়।”
ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ১৯৫০ সালের পর থেকে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার ১৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস দুটি, ডাউকি ফল্ট এবং সিলেট-চট্টগ্রাম-টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ ফল্ট জোন। এই অঞ্চলকে বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বিপজ্জনক ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় গণ্য করেন।
হুমায়ুন আখতার জানান, ভারতীয় প্লেট ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে এগিয়ে বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এতে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একটি ভয়ংকর সাবডাকশন জোন তৈরি হয়েছে, যেখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি বহুদিন ধরে আটকে আছে।
তার কথায়, “নরসিংদীতে দুই প্লেটের যে সংযোগস্থল, সেটিই লকড ছিল। শুক্রবার তার খুব সামান্য অংশ খুলে গেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে সামনে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।”
৮০০ বছর ধরে শক্তি জমছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলে দুই টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে প্রায় ৮০০ বছর ধরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। সেই শক্তি বেরিয়ে এলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটতে পারে।
হুমায়ুন আখতার সতর্ক করে বলেন, “সামান্য শক্তি বের হওয়া মানেই বড় শক্তি বের হওয়ার পথ সহজ হলো। সেটি হলে ঢাকা একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে।”
ইতিহাস বলছে, এই অঞ্চল বড় ভূমিকম্পের সাক্ষী
এই অঞ্চলে আগেও বড় বড় কম্পন হয়েছে—
১৭৯৭: ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলে যায়, বর্তমান মেঘনা নদী পশ্চিমে সরে যায়।
১৭৬২: টেকনাফ-মিয়ানমার অঞ্চলে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উঁচু হয়ে ওঠে।
১৮৯৭: ডাউকি ফল্টে ৮.৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প।
১৯২২ ও ১৮৬৮: সিলেট-মৌলভীবাজার–কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প।
ঢাকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প যেকোনো উৎস থেকেই হোক- ডাউকি ফল্ট বা চট্টগ্রাম-সিলেট সাবডাকশন জোন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে ঢাকা।
সতর্কতার বার্তা স্পষ্ট: এখনই প্রস্তুতি না নিলে বড় ধরনের দুর্যোগ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।