
গাজা শহরের একটি আবাসিক এলাকায় ভয়াবহ বিমান হামলায় একই পরিবারের ২৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন, যা সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো এই হামলায় বহু বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মানুষ আটকে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, গাজা সিটির সাবরা এলাকায় এই হামলা চালায় ইসরায়েল। রোববার ভোররাতে টার্গেট করা বাড়িগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে একই পরিবারের একাধিক প্রজন্ম একসঙ্গে বসবাস করছিল। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
গাজা শহরের সাবরা এলাকায় গত আগস্টের শেষ দিক থেকেই ইসরায়েলি বাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে অভিযান শুরু করেছিল। রবিবারের বোমা হামলায় পুরো এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখা যায়। এখন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও আরও অন্তত ৫০ জন আটকা পড়ে আছেন বলে জানিয়েছে তাঁদের পরিবার।
পরিবারের সদস্যরা নিরন্তর খালি হাতে মাটি খুঁড়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। বেঁচে থাকা স্বজনদের আর্তনাদ ও আকুতি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
“আমি সারা বিশ্বের কাছে আবেদন করছি; আমাদের সহায়তা করুন। আমাদের আত্মীয়রা জীবন্ত চাপা পড়েছে। আমরা তাদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু পৌঁছাতে পারছি না।” ঘটনাস্থল থেকে এমনই আবেদন জানালেন এক আত্মীয়।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “প্রতি পাঁচজন উদ্ধারকর্মীর মধ্যে চারজন গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছেন, একজনই বেঁচে ফিরছেন। উদ্ধারকাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ড্রোন থেকে গুলি চালানো হচ্ছে।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট যানবাহনে আহত ও নিহতদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। এক ভিডিওতে এক বিধ্বস্ত মা বিলাপ করছেন, “আমার সব সন্তানকে হারালাম।”
এছাড়া গাজা সিটির আরও কয়েকটি এলাকায়ও ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার খবর পাওয়া গেছে। পশ্চিমাঞ্চলের শাতি শরণার্থী শিবির এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে তাল আল-হাওয়া এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। নাসর জেলায় একটি টাওয়ার ও তার পাশের ভবনকেও লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
মধ্য গাজার বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে চালানো আরেক হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন, যাদের মধ্যে চারজন শিশু। আল জাজিরাকে দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, এই হামলার টার্গেট ছিল জাতিসংঘের প্যালেস্টাইন শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-এর একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের পাশের এলাকা।
ওয়াফা বার্তা সংস্থা চিকিৎসা সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, কেবল রোববার ভোর থেকে শুরু হওয়া হামলায় অন্তত ৬৮ জন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৬৫ হাজার ২৮৩ জন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৫ জন।
রোববার শুধু বোমার আঘাতে নয়, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষেও চারজন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪০ জনে, যার মধ্যে ১৪৭ জন শিশু।
অন্যদিকে, গাজা সিটির বিভিন্ন এলাকায় বহু ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই অভিযানকে গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং হাজারো মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বন্দিদের পরিবারগুলো এই অভিযান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানাচ্ছেন, “মানুষের চলাচল কার্যত থেমে গেছে। রাস্তায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর আশপাশে রিমোট-কন্ট্রোল বিস্ফোরক রোবট বসানো হয়েছে। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে গাজা সিটি ছেড়ে অন্তত ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যদিও গাজার কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তুচ্যুতের প্রকৃত সংখ্যা তিন লাখের কম, এবং এখনও প্রায় ৯ লাখ মানুষ শহরে অবস্থান করছেন।
বর্তমানে ইসরায়েলি বাহিনীর তিনটি ডিভিশন গাজা সিটি ও উত্তরাঞ্চলে এবং আরেকটি ডিভিশন খান ইউনিসে মোতায়েন রয়েছে। তাদের দাবি, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা বেশ কয়েকজন “সন্ত্রাসী”কে হত্যা করেছে, যারা হামলার পরিকল্পনায় জড়িত ছিল।
এদিকে, পোপ লিও রোববার জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “পবিত্র ভূমির গির্জার নেতাদের সঙ্গে আমিও পুনরায় বলছি; সহিংসতা, জোরপূর্বক নির্বাসন ও প্রতিশোধের ওপর কোনও ভবিষ্যৎ দাঁড়াতে পারে না।”