
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন সেই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিলেও এটি অত্যন্ত কঠিন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্রিটিশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত তাদের নতুন ডকুমেন্টারি বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট-এ দাবি করেছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।
ডকুমেন্টারিতে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে দেশের বাইরে চলে গেল এবং আদৌ তা ফিরে আসবে কি না।
আন্দোলন ও ক্ষমতার পতন
ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে বিতর্কের জেরে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ চরমে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হন, ঢাকার দেয়াল জুড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি আঁকা হয়।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রাফিয়া রেহনুমা হৃদি জানান, প্রথম দিকে সংঘর্ষ এড়ানো হলেও ১৪ জুলাই পুলিশ বাধা দেওয়া শুরু করে। অপর সমন্বয়ক রিজওয়ান আহমেদ রিফাত অভিযোগ করেন, সরকারি বাহিনী ও সন্ত্রাসীরা গুলি, স্নাইপার শট, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে শেলও নিক্ষেপ করে।
৫ আগস্ট পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায় সেদিন নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এই আন্দোলনে ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থের বড় অংশ যুক্তরাজ্যে গেছে বলে ধারণা করা হয়। লন্ডনের শক্তিশালী আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট বাজার বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পরিবারকেও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ও মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
এছাড়া, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তি থাকার প্রমাণ মেলে। ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা (এসসিএ) ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তি জব্দ করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংক ও ব্যবসা খাতে সংঘটিত এ লুটপাট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়। অনুমান অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
ব্যাংক দখল ও ভুয়া ঋণ
ডকুমেন্টারিতে আরও বলা হয়, হাসিনার ঘনিষ্ঠরা সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অস্ত্রের মুখে পরিচালক বদল করতেন। এরপর ভুয়া ঋণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হতো।
অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ
হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন। তিনি সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেন এবং লুট হওয়া অর্থ উদ্ধারে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অন্তত ১১টি ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এগুলো টিকিয়ে রাখতে ইতোমধ্যে সরকার ২৯০ বিলিয়ন টাকা ঢেলেছে। নতুন বিনিয়োগকারীরও খোঁজ চলছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অর্থ ফেরত আনা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ হবে। লন্ডনের এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোশতাক খানসহ অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বছরের পর বছর ধরে লড়াই করতে হতে পারে।
পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ
ডকুমেন্টারিতে আরও তুলে ধরা হয়েছে দুর্নীতি, দায়মুক্তি ও জবাবদিহির অভাব কীভাবে জনঅসন্তোষকে বিস্ফোরণে রূপ দেয়। বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্রদের আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতন ত্বরান্বিত করে।
তবে এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের চাপ বাড়ছে। তিনি জানিয়েছেন, আগে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে হবে। সম্ভাব্য পরবর্তী নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মত, জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হলেও মৌলিক সংস্কার ছাড়া দেশ আবারও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত শাসনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।