.png)
২০২৫ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির হিসাবে, গণপিটুনি ও সংঘবদ্ধ সহিংসতায় বছরজুড়ে মব সন্ত্রাসে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯৭ জন, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৫: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ, আসকের নিজস্ব নজরদারি এবং মাঠপর্যায়ের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে দেখা যায়—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে অন্তত ২৯৩ জন মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এ সময়ে নারী-পুরুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ নৃশংস সহিংসতার শিকার হন। মুক্তিযোদ্ধা ও বাউল সম্প্রদায়ের সদস্যদের হেনস্তা, মারধর এবং জুতার মালা পরানোর ঘটনাও নথিভুক্ত হয়েছে।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মব সন্ত্রাসে ঢাকায় নিহত হয়েছেন ২৭ জন, গাজীপুরে ১৭, নারায়ণগঞ্জে ১১, চট্টগ্রামে ৯ এবং কুমিল্লায় ৮ জন। ময়মনসিংহ, বরিশাল, নোয়াখালী, গাইবান্ধা ও শরীয়তপুরে ৬ জন করে প্রাণ হারান। লক্ষ্মীপুর ও সিরাজগঞ্জে ৫ জন করে এবং নরসিংদী ও যশোরে ৪ জন করে নিহত হন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে গণপিটুনির ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৭ জন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, ৩ জন নারী এবং একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি—যা সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতার অসম প্রভাবকে স্পষ্ট করে।
আসক জানায়, রাজনৈতিক মতভিন্নতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, গুজব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মব সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। ‘তওহীদী জনতা’ নাম ব্যবহার করে ইতিহাস ও শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভাঙচুর, নারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ৩৮টি ঘটনার মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, যৌথ বাহিনীর হেফাজত এবং তথাকথিত ‘গুলিতে’ বা বন্দুকযুদ্ধে ২৬ জন নিহত হন। থানায় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১২টি। আগের বছর ২০২৪ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যায় নিহত হয়েছিলেন ২১ জন।
একই বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে কমপক্ষে ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে—এর মধ্যে হাজতি ৬৯ জন এবং কয়েদি ৩৮ জন। সর্বোচ্চ ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে পরিকল্পিত হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এতে সাংবাদিক ও কর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন এবং পত্রিকা দুটির মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়—যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত।
আসকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে রয়ে গেছে। ভিন্নমত প্রকাশের কারণে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ, মামলা ও গ্রেপ্তারের আশঙ্কা গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করছে।
আসকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে দেশে ৪০১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১০২ জন নিহত এবং প্রায় ৪,৮৪৪ জন আহত হন। একই সময়ে ৩৮১ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন; এদের মধ্যে তিনজন নিহত এবং চারজনের মরদেহ রহস্যজনকভাবে উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া ২০২৫ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ৪২টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এসব ঘটনায় বসতঘরে অগ্নিসংযোগ, মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এতে একজন নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত হন। একই সময়ে একটি বৌদ্ধ মন্দিরেও হামলার ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, মব গঠন করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত হামলা, হত্যা, ভাঙচুর ও লুটপাট দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও গভীর উদ্বেগের দিকে ঠেলে দিয়েছে।