.jpg)
রাজনীতির বর্তমান অচলাবস্থা ও গণতন্ত্রের দুর্বলতার দায় শুধু নেতৃত্বের নয়, সমাজের সব অংশই নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, ভোটের দিনটিকে গণতন্ত্র ভাবার ভুল ধারণাই আজকের সংকটকে আরও গভীর করেছে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব মন্তব্য করেন। অধিবেশনের সঞ্চালনায় ছিলেন বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. এনামুল হক।
গভর্নর বলেন, “আমরা যে রাজনৈতিক সংকট এবং গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছি, তার দায় শুধু কোনো নেতা বা সরকারের নয়; বরং সমাজের বিভিন্ন অংশ- ভোটার, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রশাসন- সবাই মিলে নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে। ভোট দেওয়ার দিনটিকেই আমরা গণতন্ত্র ভেবে নিয়েছি, অথচ গণতন্ত্র হল প্রতিদিনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, নৈতিকতা বজায় রাখা এবং নেতৃত্বকে নিয়মিত মূল্যায়ন করা।”
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “শেখ হাসিনা একজন জননেত্রী হিসেবে রাজনীতিতে এসেছিলেন, স্বৈরাচার হয়ে জন্মাননি। কিন্তু সমাজ যখন নৈতিকতা হারায়, প্রশাসন নিজের অবস্থান থেকে সরে যায়, বুদ্ধিজীবীরা দলীয় স্বার্থে নীরব থাকেন এবং ভোটার যোগ্যতার বদলে শুধু মার্কা দেখে ভোট দেন- তখন আমরাই তাকে এমন অবস্থানে বসাই; যেখানে ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। তাই তাকে স্বৈরাচার করেছে সিস্টেম এবং সেই সিস্টেমের নির্মাতা আমরাই।”
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের এক বৈঠকে “আমি তোমাকেই চাই, বারে বারে শুধু তোমাকেই চাই”- এই বক্তব্যই প্রমাণ করে সমাজের বিভিন্ন স্তর কীভাবে নেতৃত্বকে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার দিকে ঠেলে দেয়। তার মতে, এই বাস্তবতা নিয়ে আত্মসমালোচনা জরুরি।
গভর্নর বলেন, গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক সমাজ বা বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী কোথাও “কোনো আলোড়ন দেখা যায়নি”- যা তার মতে অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি কোনো দলকে সমর্থন করতেই পারি, কিন্তু ‘নট বিয়ন্ড নর্ম’।''
জনগণের ভোটাভ্যাস নিয়েও তিনি সমালোচনা করেন। তার ভাষায়, যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শুধু দল বা মার্কা দেখে ভোট দেন। এতে “যারা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য আনতে পারতেন, তারা হারিয়ে যান।” এই সংস্কৃতি ক্ষমতাকে একচেটিয়া করে তোলে এবং নেতার চারপাশে সুবিধাভোগীদের শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি করে, ফলে জবাবদিহিতা সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, “জনগণ এখনও প্রার্থীর যোগ্যতা নয়; বরং দল ও মার্কা দেখে ভোট দেন। ফলে যোগ্য নেতৃত্ব পথেই আসে না এবং এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেই স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা জন্ম নেয়।”
তার মতে, “গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে; একটিকে দুর্বল রেখে অন্যটিকে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব।”
বক্তব্যে একাত্মতা প্রকাশ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, “শক্তিশালী গণতন্ত্র ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব নয়; সুতরাং গণতন্ত্রকে দুর্বল রেখে আর্থিক উন্নয়নের আশা করা বিভ্রান্তিকর।”