
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেলের সামনে তিনি জবানবন্দি দেন।
ট্রাইব্যুনালে এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম এবং গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, ফারুক আহাম্মদ ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আমিনুল গনি টিটু ও আজিজুর রহমান দুলু।
মামলায় মোট ৩০ জন আসামি রয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল এবং আনোয়ার পারভেজ। বাকি ২৪ জন এখনও পলাতক।
এদিন অভিযুক্ত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে ট্রাইব্যুনালে হাসনাত আব্দুল্লাহ জবাববন্দিতে যা বলেছেন তা হলো -
‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই দুপুরে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বের হয়ে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে গুম করা হয়েছে এবং তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেজন্য আমি, সারজিস, নাহিদের বাবা-মা নাহিদকে খুঁজতে থাকি। ডিবি অফিস ও সিআইডি অফিসে অভিযোগ দায়ের করতে গেলে আমাদের কোনো অভিযোগ নেওয়া হয় নাই। বের হয়ে আমরা আরও জানতে পারি যে, অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ৯ দফা ঘোষণা করেছেন। এবং এই ৯ দফা দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়। বের হয়ে আমরা আন্দোলনে আহত, নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যাসহ, নির্যাতনের মাত্রা অবগত হই। এর মধ্যে নাহিদকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং তাকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমরা নাহিদের সাঙ্গে দেখা করতে যাই এবং আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করি। সেখানে গিয়ে দেখি যে, হাসপাতাল এলাকায় আইন শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
১৯ জুলাই রাতে তৎকালীন সরকার আন্দোলন দমনের জন্য পরের দিন থেকে কারফিউ ঘোষণা করে। কারফিউ চলাকালে আন্দোলনকারীদের দেখা মাত্র গুলি করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। আমাদের শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত ছিল এবং সারা দেশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকে। এরপর আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ ও বাকের গুম হয়। আসিফের বাবা দুই দিন পর ঢাকায় এসে তার সন্তানের খোঁজ করতে থাকেন। আমরা তাকে সাথে নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলন করি। সেই সংবাদ সম্মেলনেও আন্দোলন প্রত্যাহার করতে ডিজিএফআই নাহিদকে চাপ প্রয়োগ করে। নাহিদ চাপ উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
এর পরের দিন আসিফ ও বাকেরকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং তাদেরকেও গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে তাদেরকে দেখতে গেলে আমাকে বাধা দেওয়া হয় এবং গ্রেপ্তার করার হুমকি দেওয়া হয়।
২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে আসিফ, বাকের ও নাহিদকে তুলে নিয়ে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরদিন ২৭ জুলাই দুপুর ১২টায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা থেকে আমাকে ও সারজিসকে তুলে নিয়ে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৮ জুলাই অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে আমাদের প্রত্যেককে একজন এডিসির অধীনে রাখা হয়। আমি ছিলাম এডিসি জুনায়েদের অধীনে। তিনি আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেন। আমাকে একবার সারারাত বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করে সরকারের সাঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা। আমি বারবার জোর দিয়ে বলতে থাকি হয় আমাকে গ্রেপ্তার করেন না হয় ছেড়ে দেন। হেফাজতে রাখার কোনো আইনগত ভিত্তি নাই। এই সকল কার্যক্রম সমন্বয় করছিলেন ডিবি হারুন। তিনি কয়েকবার আমাদের সবাইকে তার রুমে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন হুমকি ও চাপ প্রয়োগ করতেন। সেখানেই আমাদের সবার সঙ্গে দেখা হত। আমরা একবার হাঙ্গার স্ট্রাইকের চিন্তা করি। তখন ডিবি হারুন আমাদেরকে দুপুর বেলা তার রুমে ডেকে খেতে দিয়ে খাওয়ার ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে দেন। এরপর আমরা হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করি। আমাদের আত্মীয়স্বজনকে ধরে আনা হবে মর্মে আমাদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। আত্মীয়স্বজনরা ডিবি অফিসের বাহিরে আসলেও আমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় নাই। একপর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকে ডিবি অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়। তাদেরকে দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচার করা হয়। আমরা ভেতর থেকে জানতে পারি যে, শিক্ষকেরা আমাদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছিল। ওই আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনও যুক্ত হয়।
একদিন ডিবি হারুন আমাদের ছয়জন সমন্বয়ককে তার রুমে ডেকে এনে একটি লিখিত বর্ণনা সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের হাতে দিয়ে তা পাঠ করতে বলেন। নাহিদ ইসলাম সেটি পাঠ করলে তা ভিডিও করে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে বলা হয় যে, নাহিদ ইসলাম আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে।
২০২৪ সালের ১ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার সময় আমরা প্রায় ৩০ ঘণ্টাব্যাপী অনশন অবস্থায় ছিলাম। আমরা বের হয়ে এসেই আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই।
৩ আগস্ট তারিখে নাহিদ ইসলাম শহীদ মিনার থেকে ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাষ্ট্র গঠনের একদফার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় সকল ছাত্র জনতাসহ দেশের সকল শ্রেণির মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেন।
৪ আগস্ট সায়েন্স ল্যাবরেটরি, শাহবাগ, বাড্ডা, শহীদ মিনার, মিরপুর, ইসিবি চত্বর, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, রামপুরা এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের উপর পুলিশ, বিজিবিসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলিবর্ষণ করে যাতে অসংখ্য আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হয়। রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরেও ছাত্র জনতা পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ধারা আক্রান্ত হয়।
আমরা ৫ ‘বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ’ কর্মসূচি এবং ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেই। কিন্তু সরকার ও আওয়ামী লীগের আন্দোলন প্রতিহত করতে ব্যাপক প্রস্তুতির খবর জানতে পেরে আমরা ৪ আগস্ট রাত ১১/১২টার সময় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভোর থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের উদ্দেশ্যে সারাদেশ থেকে সাধারণ ছাত্র জনতা ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করে। আমি বিজয় সরণি এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে আমরা খবর পাই যে, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সেনা প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখন আমরা নিশ্চিত হই হাসিনার দুঃশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। একই সঙ্গে আমরা ঘোষণা করি যে, কোন সেনাশাসন আমরা মানব না।
তারপর আমরা সকলে একত্রিত হয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতিকে জানাই আগামী দুই/একদিনের মধ্যে নতুন সরকার গঠিত হবে এবং সে পর্যন্ত শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য জনগণকে আহ্বান জানাই। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
সরকার পতনের পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিবিসি ও আল জাজিরাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে প্রায় এক হাজার ৪০০ আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শহীদ হন এবং ২৫ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা আহত হয়। এ সময়কালে আশুলিয়াতে ৬ জনকে পুড়িয়ে দেওয়া, সাভারে ইয়ামিনকে এপিসি থেকে ফেলে দেওয়া, হাসপাতালে সামনে রিকশা চালককে গুলি করে হত্যা করা, আহতদের চিকিৎসা গ্রহণে বাধা প্রদান করার মতো অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের জন্য আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তৎকালীন আইজিপি, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং যারা সরাসরি গুলি করেছে তাদেরকে দায়ী করছি। আমি অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শান্তি এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাই।
আমি আবু সাঈদসহ ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহত হওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের সকলের বিচার চাই। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।’
চলতি বছরের ২৭ আগস্ট এই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়, সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর পর ২৮ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই, যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন।
২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কও ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের হাতে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই হত্যার প্রতিবাদে হাজারো মানুষ সোচ্চার হন, যা আন্দোলনকে আরও গতিশীল করে।
অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার এবং সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ আসে। এই সকল অপরাধের বিচার বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলছে।